পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৪৩

এবং ঢাকা থেকে পাঠানো টেলেক্স-এ খবর পাই। হাবিবুর রহমান, সুলতান শরীফ এবং অন্য কয়েকজন আমার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন। মিঃ হাবিবুর রহমান আমাকে পররাষ্ট্র দপ্তরে নিয়ে যান। পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে ফিরে এসে আমার স্ত্রীকে আমার সিদ্ধান্তের কথা জানাই। সে অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে আমার এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

 ইতিমধ্যে বহু বাঙ্গালী জড় হতে থাকে। সবার নাম মনে রাখা সম্ভব নয়। তবে বিশেষভাবে আমি কয়েকজন ডাক্তারের কথা বলতে চাই যাঁরা স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। নয় মাস ধরে যে আন্দোলন চলে তাতে কিছু কিছু কর্মীর কাছ থেকে বিভিন্ন অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় কিন্তু ডাক্তার কর্মীরা কোনদিন কোন অসুবিধা করেননি বরং তাদের ত্যাগ, কর্মনিষ্ঠা এবং কষ্টসহিষ্ণুতা অন্যদের জন্য আদর্শ হিসেবে প্রজ্বলিত ছিল। ডাঃ আব্দুল হাকিম, ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী এবং মোশারফ হোসেন জোয়ারদার সারাক্ষণ পরিশ্রম করতেন।

 এখানে বলা প্রয়োজন যে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমগ্র বৃটেনে বাঙ্গালীদের মধ্যে এই আন্দোলন গড়ে ওঠে। প্রায় প্রতিটি বাঙ্গালী এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয় এবং বিভিন্ন এলাকায় কমিটি গঠন করে। কিন্তু একটি সংগঠনের সাথে অন্য সংগঠনের যোগাযোগ ছিল কম যার ফলে নেতৃত্বের প্রশ্নে বিরোধ দেখা দেয়, এবং নিজেদের মধ্যে কলহের সৃষ্টি হয়। প্রত্যেক দলই আমাকে তাদের দলে যোগ দেয়ার জন্য চাপ দেয় কিন্তু আমি একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত না হলে কোন দলেই যোগ দেব না বলে জানাই।

 লর্ড হিউমের সাথে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করা হয়। এই মধ্যবর্তী সময় আমি বিভিন্ন একাডেমিসীয়ান এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রধানের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে থাকি। এ ছাড়া বৃটিশ পার্লামেণ্টের সদস্যদের সঙ্গেও দেখা করি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার এ্যালেন বুলক এবং ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য লর্ড জেমস-এর সঙ্গে দেখা করি। তাঁরা আমাকে স্যার হিউ স্প্রিংগার-এর সঙ্গে দেখা করতে বলেন। তিনি ছিলেন কমনওয়েলথ বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং কমনওয়েলথ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের মুখপাত্র।

 ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের লর্ড জেমস একটি মধ্যাহ্নভোজের ব্যাবস্থা করেন এবং প্রায় বিশজন বিভাগীয় প্রধানকে ঐ ভোজে দাওয়াত করেন। আমি তাদের কাছে বাংলাদেশের অবস্থা বর্ণনা করি এবং তাঁরা গভীর সহানুভূতির সঙ্গে তা শোনেন। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালে লর্ড জেমস ঢাকায় গিয়েছিলেন। তিনি ভবিষ্যত বাণী করেন যে, ছয় মাসের মধ্যে বাংলাদেশে স্বাধীন হবে। পূর্ব পাকিস্তানকে কলোনী হিসেবে ব্যবহার করা আর সম্ভব হবে না। এর পরে আমি স্যার হিউ স্প্রিংগার-এর সাথে দেখা করি। তিনি বলেন, “হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা আমার নৈতিক দায়িত্ব। তিনি আরো বলেন, তিনি তখনি ইয়াহিয়া খানকে একটি টেলিগ্রাম করবেন বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার জন্য।

 তারপর আমি ঢাকা আন্তর্জাতিক জুরিষ্ট কমিশনের সাধারণ সম্পাদককে টেলিফোন করে সমস্ত ব্যাপার জানাই। তিনি পাকিস্তান সরকারের কাছে একটি তারবার্তা পাঠান। তাতে তিনি হত্যাযজ্ঞ বন্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য অনুরোধ জানান।

 বাংলাদেশ আন্দোলনে তৎপর বিভিন্ন সংগঠন একত্রীকরণ করার জন্য আমরা সকলেই চেষ্টা করি। এই কাজটি ছিল অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। রাত দু’টা তিনটা পর্যন্ত মিটিং চলতো এবং বাড়ী ফিরে নিজের কাছে শপথ করতাম যে পরদিন আর যাবো না। কে কোন দলের নেতা হবেন তা নিয়ে মতবিরোধ ছিল। কিন্তু পরদিন আবার ঠিকই যেতাম।

 ১০ই এপ্রিল লর্ড হিউম-এর সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়। সাদারল্যাণ্ড এবং ব্যারিংটন আমাকে তাঁর কাছে দিয়ে যান। লর্ড হিউম আমাকে দেখার সাথে সাথেই বলেন যে তিনি পাকিস্তানের হাইকমিশনারের সঙ্গে কথা বলেছেন। অবস্থা ঠিকই আছে, চিন্তার কোন কারণ নেই। আমি বলি শুধুমাত্র একজনের কথাতেই প্রমাণ হয় না