পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৭৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৪৮

ডেনমার্ক সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। তারা আমাকে আশ্বাস দেন যে এই অস্ত্র কিছুতেই পাঠাতে দেয়া হবে না। এই ঘটনাটি থেকে বোঝা যায় যে, আমাদের আন্দোলনের প্রতি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সাধারণ মানুষের কি ধরনের সমর্থন ছিল। এছাড়া আমি বিরোধী দলের নেতা পল হার্টলিংক-এর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করি।

 নরওয়েতে দশ-বার জনের বেশী বাঙ্গালী ছিল না কিন্তু আন্দোলন ছিল ব্যাপক। এর কারণ, নরওয়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী ছাত্র নেতা মিঃ বুল আমাদের আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন। তিনি আমাদের জন্য জনমতের জোয়ার সৃষ্টি করেন। তাদের প্রচেষ্টায় জাতীয় টেলিভিশনে আমার বক্তৃতা প্রচার হয়। এক সন্ধ্যায় আমি ছাত্র পরিষদের কার্যকরী কমিটির উদ্দেশে ভাষণ দিই। অসলো বিশ্ববিদ্যালয়েও আমি বহু ছাত্র সমাবেশে একটি ভাষণ দিই। আমি লক্ষ্য করি নরওয়ের ছাত্ররা আমাদের আন্দোলনকে তাদের নিজেদের আন্দোলন বলে মনে করে। একজন ছাত্র (শিল্পী) ইয়াহিয়া খানের একটি ছবি আঁকেন। তাকে একজন হত্যাকারী হিসেবে চিত্রিত করে। কয়েকজন পাকিস্তানী এই ছবিটি ছিঁড়ে ফেলে। এর ফলে পাকিস্তানের প্রতি তাদের মনোভাব আরো বিরূপ হয়ে ওঠে।

 অসলোর মেয়র আমাকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে অভ্যর্থনা জানান এবং একটি গ্রন্থে আমাকে সরাসরিভাবে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে উল্লেখ করেন।

 আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং আইন বিষয়ের প্রধানের সাথে একটি কমিটি গঠনের ব্যাপারে আলোচনা করি।

 নরওয়ের প্রধান বিচারপতি পিয়ের ওল্ড আমাকে আমন্ত্রণ জানান। সেখানে অন্যান্য বিচারপতিরাও ছিলেন। তিনি আমার পুরানো বন্ধু। এছাড়া আমি রোটারি ক্লাবে বক্তব্য রাখি। সাধারণত এই ফোরামে কোন রাজনৈতিক বক্তব্য রাখতে দেয়া হয় না। কিন্তু আমার বেলায় ব্যতিক্রম হয়। আমি সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে আমাদের সমস্ত বক্তব্য পেশ করি এবং উপস্থিত সুধীমণ্ডলীর কাছ থেকে প্রচুর সাড়া পাই। সম্ভবতঃ নরওয়ে রোটারী ক্লাবে এই ধরনের ব্যতিক্রশী ঘটনা ঘটেনি। সুইডেনে জনাব রাজ্জাক যিনি পূর্ব পাকিস্তান পররাষ্ট্র বিভাগে কর্মরত ছিলেন আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হন। তিনি আমার সাথে এয়ারপোর্টে দেখা করেন এবং বলেন যে, বিশ্ববিখ্যাত অর্থনীতিবিদ গুনার মিরডালের সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা হয়েছে। তাঁর সঙ্গে দেখা করে আমি খুবই আনন্দিত হই। তিনি আমাদের আন্দোলনের প্রতি তাঁর পূর্ণ সমর্থনের কথা জানান। শুধু তাই নয়, তিনি বাংলাদেশ এ্যাকশান কমিটির সুইডেন শাখারও প্রধান হিসেবে কাজ করতে রাজী হন এবং তাঁর অফিস সেই দিন থেকে এ্যাকশান কমিটি অফিসে পরিণত হয়। তাঁর বুকে স্বাধীন বাংলাদেশের ব্যাজ পরিয়ে দিই। এ সময় তাঁর মাধ্যমেই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা সম্পাদকদের সাথে আমার যোগাযোগ হয় এবং তারা আমাদের সব ধরনের সাহয্যের প্রতিশ্রুতি দেন। তৎকালীন ক্ষমতাসীন পার্টির সাধারণ সম্পাদকের সাথেও আমার দেখা হয়। তিনি আমাকে বলেন যে, মৌখিক সমর্থন যথেষ্ট নয়, তাঁরা এর চেয়ে বেশী করতে প্রস্তুত। তিনি বলেন যে, সরাসরিভাবে তাঁরা মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করবেন। যা হোক যদিও এর পরপরই দেশ স্বাধীন হয়ে যাবার জন্য অস্ত্রের আর প্রয়োজন হয়নি তবুও তাদের সদিচ্ছার তুলনা বিরল।

 আমি যখন হেলসিংকি বিমানবন্দরে অবতরণ করি আমাকে প্রথমে অভ্যর্থনা করেন সেখানকার বৃটিশ কনসাল জেনারেল মিঃ রয় ফক্স। আমি খুবই আশ্চর্য হই এবং তাকে আমার সফরের উদ্দেশ্য জানাই। একজন বিদেশী কূটনীতিক হিসেবে আমার সংগে মেলামেশায় বিপদের সম্ভাবনার কথা তাকে জানাই। ফক্স আমাকে বলেন, আমি তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধু এবং বৃটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের কোন অধিকার নাই তার ব্যক্তিগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার। তিনি আমাকে তাঁর বাসায় নিয়ে যান এবং তাঁর অতিথি হবার জন্য আমন্ত্রণ জানান। যাহোক, বহু কষ্টে তাঁকে বুঝিয়ে আমি সন্ধ্যা বেলায় তাঁর বাসা থেকে হোটেলে উঠে আসি। টিভিতে আমার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। এছাড়া আমি পার্লামেণ্ট ভবনে গিয়ে সংসদ সদস্যদের সাথে দেখা করি এবং আমাদের বক্তব্য প্রচার করি।