পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৫৪

জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। বাংলার মাঠে ঘাটে, হাটে বাজারে সর্বত্র আন্দোলন দানা বেঁধে উঠে। এদিকে বিভিন্ন স্থানে সামরিক জান্তার গুলীতে বেশ কিছু লোক হতাহত হয়।

 বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলতে থাকে। বঙ্গবন্ধু ১লা মার্চ নিজেই বলেছেন ৭ই মার্চে রেসকোর্সের জনসভায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচী ঘোষণা করবেনা। বিভিন্ন দেশ থেকে বহু সাংবাদিক বাংলা দেশে আসেন। ধানমণ্ডির ৩২নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর ৬৭৭ নম্বর বাড়ী সংগ্রামের সূতিকাগারে পরিণত হয়। সকালে বিকালে দেশী বিদেশী সাংবাদিক এই বাড়ীতে এসে ভীড় জমান। তারা সুযোগ পেলেই বঙ্গবন্ধুর নিকট থেকে বিভিন্নভাবে আন্দোলন ও ভবিষ্যত কর্মসূচী জানতে চান।

 আর পাক বাহিনীও সুযোগের প্রতীক্ষায় থাকে। শোনা যায়, রেসকোর্সের জনসভাকে লক্ষ্য করে ঢাকা সেনানিবাসে কামান বসানো হয়। শেখ মুজিব যদি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন তাহলে জনসভায় গোলা বর্ষণ করা হবে।

 ইতিমধ্যে লক্ষ্য করলাম বঙ্গবন্ধু অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠেছেন। সারা দেশের মানুষের প্রাণঢালা ভালবাসা ও সমর্থন তাঁকে দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ী করে তুলেছে। তখন তার একটি কথাই ছিল বঙ্গালীর মনের কথা।

 বঙ্গবন্ধুর মনের কথা তাজউদ্দিন আহমদের জানা ছিল। বঙ্গবন্ধুর ইঙ্গিতই তাঁর জন্য যথেষ্ট ছিল। বিভিন্ন সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের খসড়া আমরা রচনা করে দিতাম। নেতার নির্দেশ অনুযায়ী তা করা হতো। তাজউদ্দিন আহমদ মুষ্টিবদ্ধ হাত মুখে রেখে কান পেতে কথা শুনতেন। একজন নিখুঁত শিল্পীর মত আমাদের রচিত খসড়াগুলো তিনি শুনতেন। এরপর তিনি বক্তব্যের খসড়া বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে যেতেন। আমাদের রচিত খসড়া বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই বঙ্গবন্ধুর পছন্দ হতো। কোন কোন সময় তিনি কিছু পরিবর্তন করতেন। ৭ই মার্চের বক্তৃতা সম্পর্কে আওয়ামী লীগের বৈঠকে দীর্ঘ আলোচনা হয়। আলোচনার পর বক্তব্যের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুকে সর্বময় ক্ষমতা দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু আমাদেরকে খসড়া বক্তব্য লেখার জন্য নির্দেশ দেন। ৭ই মার্চ অপরাহ্নে বঙ্গবন্ধুর পায়ের কাছে বসে রেসকোর্সের ময়দানে মন্ত্রমুগ্ধের মত তাঁর বক্তব্য শুনছিলাম। তিনি সেদিন তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে বাঙ্গালী জাতির পথ নির্দেশ করেন। তিনি বাঙ্গালী জাতির দীর্ঘদিনের ক্ষোভ নির্যাতন ও নিষ্পেষণের কথা উল্লেখ করেন, বাঙ্গলী জাতিকে মরণপণ যুদ্ধের প্রস্তুতির আহ্বান জানান। সঙ্গে সঙ্গে তিনি জাতিকে স্বাধীনতা ও মুক্তির বাণী শোনান। বক্তৃতা একদিকে ছিল যেমন আবেগময়ী অপরদিকে ছিল নির্ভূল যুক্তি ও গভীর আত্মপ্রত্যয়ী।

 প্রকৃতপক্ষে পহেলা মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাংলাদেশ পরিচালিত হয়। বক্তৃতার পর বঙ্গবন্ধু বলেন আমি স্বাধীনতা ঘোষণা করে আমার দায়িত্ব পালন করেছি। এখন দেশবাসীর দায়িত্ব হল হানাদার বাহিনীকে দেশ থেকে বিতাড়িত করা। বাংলার মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিপাগল মানুষ সে দায়িত্ব পালন করেছে একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বর।

 কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের বক্তৃতাকে আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ বক্তৃতার সাথে তুলনা করেন। বঙ্গবন্ধু জীবনে ৭ই মার্চের আগে ও পরে অসংখ্য বক্তৃতা করে গেছেন। ৭ই মার্চের বক্তৃতার সাথে তাঁর অন্য কোন বক্তৃতার তুলনা হয় কি? মুক্তিযুদ্ধকালে ৭ই মার্চের বক্তৃতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা মরণপণ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাই আমি মনে করি, ৭ই মার্চের বক্তৃতা এক অনন্য বক্তৃতা, যার সাথে পৃথিবীর অন্য কোন বক্তৃতারই তুলনা চলে না। তাই বাঙ্গালী জাতি যতদিন বিশ্বের বুকে বেঁচে থাকবে ততদিনই এই বক্তৃতার দ্বারা আলোড়িত হবে। বাঙ্গালী জাতির জীবনে এই বক্তৃতা অক্ষয় হয়ে থাকবে।

 ৭ই মার্চের বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু আন্দোলনের নয়া কর্মসূচী ঘোষণা করেন। দেশের সর্বত্র শহরে বন্দরে নগরে গ্রামে গঞ্জে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জনসভা, বিক্ষোভ মিছিল ও শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হতে থাকে। ১৫ই