পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৫৫

মার্চ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ ৩৫টি নির্দেশ জারী করেন। এই নির্দেশের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সর্বময় দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৭ই মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। এদিন সকালে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের এক বৈঠক ডাকেন। বৈঠকে বঙ্গবন্ধু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মতামত ব্যক্ত করার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান। বৈঠকে উপস্থিত দুই-একজন ছাড়া সকলেই এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে পাক সশস্ত্র বাহিনীর মোকাবেলা সশস্ত্রভাবেই করতে হবে। এই বৈঠকে অন্য একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। সেটা হল এই পরিস্থিতিতে আমরা বিদেশের কাছ থেকে কি রকম সাড়া বা সাহয্য পেতে পারি।

 আমি এই বৈঠকে আমার বক্তব্য তুলে ধরি। চার্চিলের ‘উই আর এলোন অন দি ব্রিজ’ এই উদ্ধৃতি দিয়েই বক্তৃতা শুরু করি। বাংলাদেশের আন্দোলন সম্পর্কে বিদেশের সাথে আমাদের যোগাযোগ ছিল না। সত্তরের ১২ই নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ের পর বাংলাদেশের মানুষের প্রতি বিশ্ববাসীর সমর্থন বাড়তে থাকে। এরপর জাতীয় সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নিরংকুশ বিজয় সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এরপর ঐতিহাসিক আন্দোলনের খবর বহির্বিশ্বের পত্র-পত্রিকায় ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হয়। কিন্তু বিদেশের কোন সরকার বা উচ্চপর্যায়ের লবির সাথে আমাদের কোন যোগাযোগ ছিল না। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সে তুলনায় আমাদের বলতে গেলে কোন যোগাযোগই ছিল না।

 আমার বক্তৃতার পর তাজউদ্দিন আহমদ বক্তৃতা করেন। তিনি আমার বক্তব্য সমর্থন করে কর্তব্য সম্পর্কে ইঙ্গিত দেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ও জনগণের ঐক্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তাজউদ্দিন আহমদ বলেন যুদ্ধে পাকিস্তানের সাথে মোকাবেলা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই সংগ্রামকে গণভিত্তিক সশস্ত্র সংগ্রামে পরিণত করতে হবে। সভাপতির ভাষণে বঙ্গবন্ধু সশস্ত্র যুদ্ধের মোকাবেলায় সকলকে প্রস্তুত থাকার ইঙ্গিত দেন।

 এদিকে ঢাকায় প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া খান ও তার সহকর্মীদের সাথে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহকর্মীদের আলোচনা অব্যাহত থাকে। ২৩শে মার্চ পাকিস্তান দিবসে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে প্রতিরোধ দিবস পালন করা হয়। ঐ দিন বঙ্গবন্ধুর বাসভবনসহ বাংলাদেশের সর্বত্র স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।

 ঐদিন সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে প্রেসিডেণ্টের কাছে শাসনতন্ত্রের একটি খসড়া পেশ করা হয়। এই খসড়াটি মূল অংশগুলো মেনে নেয়া হবে প্রেসিডেণ্টের পক্ষ থেকে এ ধরনের একটা ধারণা দেয়া হয়। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবার কথা পরবর্তী বৈঠকে। ২৪শে মার্চ প্রেসিডেণ্টের পক্ষ নীরব থাকে এবং সামরিক বাহিনী দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্যাতন শুরু করে। ইতিমধ্যে আমরা খবর পেয়ে গেছি যে প্রত্যহ বিমানে করে পাকিস্তান থেকে সৈন্য আনা হচ্ছে।

 চট্টগ্রাম থেকে আমরা খবর পেলাম পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ‘সোয়াত’ জাহাজে করে অস্ত্র এসেছে। বঙ্গবন্ধু হাজী গোলাম মোর্শেদের মাধ্যমে চট্টগ্রামে মেজর জিয়ার কাছে একটি নির্দেশ প্রেরণ করেন। খবরটি ছিল সোয়াত জাহাজ থেকে যেন অস্ত্র নামাতে না দেয়া হয়। এ ব্যাপারে মেজর জিয়া কোন সক্রিয় ভূমিকা পালন না করায় পারবর্তীকালে তাঁর সঙ্গে আর যোগযোগ করা হয়নি।

 ২৩শে মার্চ সকালে ঢাকা থেকে জেলা সদরে আওয়ামী লীগ সংগ্রাম কমিটির কাছে একটি নির্দেশ প্রেরণ করা হয়। নির্দেশে বলা হয়, যে কোন সময় পাক বাহিনী আমাদের ওপর হামলা চালাতে পারে। পাল্টা আঘাত হানার জন্য সকলকে প্রস্তুত থাকতে হবে। বাংলাদেশের পতাকা ইতিমধ্যেই দেশের সর্বত্র তৈরী হয়ে গেছে।