পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৫৭

 সার্কিট হাউজ রোডের ৪নম্বর বাড়ীতে আমি থাকি। কামাল হোসেন থাকেন ৩ নম্বর বাড়ীতে। আমার বাড়ীতে যাওয়ার পূর্বে কামাল হোসেনের বাড়ীতে যাই। তিনি বাড়ীর বাইরে দাঁড়িয়ে আহমেদূল কবীর ও তাঁর স্ত্রীকে বিদায় দিচ্ছেন। বিদায়ের সময় লম্বা না করার জন্য আমি তাঁদের তাড়া দিলাম। তাঁদের বিদায় দিয়ে ডঃ কামাল কি করা যায় বলে আমাকে জিজ্ঞাসা করেন। বললাম পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আপনি প্রস্তুত হোন। আমি বাসায় লীলাকে বলে আসি।

 ১লা মার্চ থেকে বাড়ীতে দুপুরে খাওয়ার সময় আসি। স্ত্রী ও পুত্র-কন্যার সাথে এক প্রকার কথাবার্তা হয় না বল্লেই চলে। আমার শ্বশুর আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা খান সাহেব এম, ওসামান আলী ১৯শে মার্চ ইন্তেকাল করেন। স্ত্রী তখনো শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। পিতৃহারা স্ত্রীকে সান্তনা দেয়ার সময়ও আমার হয়ে ওঠেনি। ঘরে প্রবেশ করে লীলাকে বললাম, আমাকে এখন চলে যেতে হবে। সে শুধু জানতে চাইলো আমার কাছে টাকা আছে কিনা। পকেটে ২/১০ টাকা থাকতে পারে। আমার পরনে পাজামা, গায়ে পাঞ্জাবী, আর পায়ে সেণ্ডেল। ‘ভালো থাক’ এ কথা বলেই স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। পূর্বের মত দেয়াল টপকিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে কামাল হোসেনের বাসায় আসি। তিনি প্রস্তুত ছিলেন।

 পথে দেখি শাহবাগের মোড়ে জনতা গাছ কেটে ব্যারিকেড সৃষ্টি করেছে। এই পথে বঙ্গবন্ধুর বাড়ীতে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ। বহু কষ্টে কর্মীদরে সহযোগিতায় রাস্তার ব্যারিকেড সরিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসায় পৌছি। বঙ্গবন্ধু যে আত্মগোপন করতে নারাজ গাড়ীতে ডঃ কামালকে সে কথা জানাই। ৩২ নম্বরের বাড়ীতে প্রবেশ করে দেখি বঙ্গবন্ধু নীচের তলায় খাবার শেষ করেছেন। দৃশ্যটি দেখে আমার ‘লাষ্ট সাপারের’ কথা মনে পড়লো। বঙ্গবন্ধুর পরনে লুঙ্গি ও গায়ে গেঞ্জী ছিল। আমাদের দু‘জনকে দেখে তিনি দরজায় আসেন। আমরা সংক্ষেপে শহরের অবস্থা জানিয়ে বঙ্গবন্ধুকে আমাদের সাথে চলে যাবার জন্য পুনরায় অনুরোধ জানাই। বঙ্গবন্ধু তার পূর্ব সিদ্ধান্তে অটল। তিনি বললেন, তোমরা প্রতিজ্ঞা পাঠ করেছ, আমি যা নির্দেশ করবো তাই শুনবে। তারপর তিনি আমাদের দু’জনের পিঠে দু’হাত রেখে বলেন, ‘কামাল, আমীরুল আমি কোনদিন তোমাদেরকে কোন আদেশ করিনি। আমি তোমাদের আজ আদেশ করছি, এই মুহূর্তে তোমরা আমার বাড়ী ছেড়ে চলে যাও। আর তোমাদের দায়িত্ব তোমরা পালন করবে’। আর শহরের অবস্থার কথা শুনে তিনি বলেন, আমি বাড়ী ছেড়ে চলে গেলে হানাদাররা আমার জন্য ঢাকা শহরের সকল লোককে হত্যা করবে। আমার জন্য আমার জনগণের জীবন যাক এটা আমি চাই না।

 বঙ্গবন্ধুর বাড়ী থেকে মোহাম্মদ মুসার বাড়ীতে যাই। আমার গাড়ী সেই বাড়ীতে রেখে মুসার গাড়ীতে উঠি মুসার ড্রাইভার গাড়ী চালায়। আমরা তাজউদ্দিন আহমদের বাড়ীতে গিয়ে উপস্থিত হই। তাজউদ্দিন ভাইকে সর্বশেষ পরিস্থিতি অবহিত করি। তাঁকে জানাই, বঙ্গবন্ধু সকলকে আত্মগোপনের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি ইতস্তত করেন।

 এ সময়ে বি ডি আর-এর একজন হাবিলদার এসে আমাদের বলে গেলেন, বি ডি আর-এর সকল বাঙ্গালী সদস্যরা বেরিয়ে পড়েছে। আজ রাতে তারা পাক বাহিনীর হামলার আশংকা করছে। তাজউদ্দিন ভাইকে তাড়াতাড়ি তৈরী হতে বল্লাম। তিনি ভেতরে গেলেন। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। ডঃ কামালকে খুবই চিন্তিত দেখাচ্ছিল। ডঃ কামাল গাড়ীযোগে অন্যত্র যেতে চাইলেন। আমি বল্লাম, এটা ঠিক হবে না। তাজউদ্দিন আহমদের কিছুটা দেরী হলো। তিনি বেরিয়ে আসলেন। তার পরনে লুঙ্গি ও গায়ে পাঞ্জাবী। কাঁধে একটি ব্যাগ ঝোলানো রয়েছে। আর তার ঘাড়ে একটি রাইফেল। তার এই বেশ দেখে আমি বল্লাম, শিকারে যাচ্ছেন নাকি?