পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৮৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৬১

ও ছোটছোট ছেলেমেয়েদের কোলে দিয়ে এসেছে এখানে। কার্ফু জারী থাকা অবস্থায়ও এলোপাতাড়ি গুলি চলে। এমন সময় একটি মাইকে কেউ বলে গেল, কিছুক্ষণের জন্য কার্ফু তুলে নেয়া হয়েছে।

 সে সময় একজন ছাত্র এ বাড়ীতে আসে। সে আমাদেরকে চিনতে পারে। তার মুখে শহরের টুকরো টুকরো খবর পেলাম। আমাদের প্রধান জিজ্ঞাসা ছিল ৩২ নাম্বারে কি হয়েছে? ছাত্রটি সঠিক কিছু বলতে পারলো না। তবে বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারে দু’ধরনের খবর শুনেছে। কেউ বলেছে বঙ্গবন্ধু সরে গেছেন। আবার কেউ বলেছে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

 বাইরে কার্ফু না থাকায় আমরা বাড়ী ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেই। আমাদের দুজনের হাতে ১টি করে বাজারের থলি। যেন আমরা বাজার করতে যাচ্ছি। তাজউদ্দিন ভাই এর পরনে লুঙ্গি ও পাঞ্জাবী, মাথায় সাদা টুপি। বাজারের থলির নীচে তার নিজের ব্যাগ রাখা হয়েছে।

 আমরা সাত মসজিদ রোডে পৌঁছি। আর একটু এগিয়ে ডান দিকে মোড় নিলে ১৯নম্বর রাস্তা। সেটা পার হলেই রায়ের বাজার। এমন সময় আমাদের পেছনে একটি মিলিটারী জীপ এলো। জীপটি চলে যেতেই আমরা আবার রাস্তায় চলে আসি। ডানে মোড় নিলে লালমাটিয়ার সীমানা পেরিয়ে ১৯ নম্বর সড়ক। ডানে মোড় নেব এ সময় তাজউদ্দিন ভাই থমকে দাঁড়ান। আর একটু এগুলেই ডান পাশে তার বাড়ী। তিনি তার বাড়ী যেতে চাইলেন। আমি জোর আপত্তি জানাই। যুক্তি দিলাম, আপনার বাড়ী নিশ্চই আক্রান্ত হয়েছিল। হায়েনার দল এখনো বাড়ীর আশেপাশে আড়ি পেতে বসে থাকতে পারে। তাজউদ্দিন ভাই-এর মনে পড়লো তার ঔষধগুলোর কথা। সেগুলো বাড়ীতে রয়ে গেছে। বাড়ীতে আর যাওয়া হলো না।

 ডান দিকে মোড় নিয়ে আমরা রায়ের বাজারে পৌঁছি। এখানে আওয়ামী লীগ কর্মীদের একটি শক্ত ঘাঁটি তখনো রয়েছে। নির্ভীক কর্মীরা সংগ্রাম কমিটির অফিস পাহারা দিচ্ছে। এদের সাহস দেখে একদিকে যেমন বিস্মিত হলাম, অপরদিকে আমার হাসিও পেল। কেননা প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে এ ধরনের মোকাবেলা সাহসের দিক দিয়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হলেও কৌশলের দিক দিয়ে একেবারেই সমর্থনযোগ্য নয়।

 পাক বাহিনীর হামলা এখানে তখনো আসেনি। এলাকাবাসীর মনে ভয়ের লেশমাত্র নেই। সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ও অন্যান্য নেতাকর্মীদের সাথে আমাদের কথা হলো। তারা আমাদের কাছে এই মুহূর্তের করণীয় জানতে চাইল। আমরা সংক্ষেপে তাদের কয়েকটি নির্দেশ দেই।

 রায়ের বাজার থেকে দুজন লোককে দুদিকে পাঠালাম। একজন গেল ৩২ নাম্বারে বঙ্গবন্ধুর খোঁজখবর জানতে, আর অপরজনকে পাঠালাম মুসা সাহেবের বাসায় ডঃ কামাল এসেছেন কিনা তা জানার জন্য। ৩২ নাম্বারের খোঁজ নিয়ে আমাদের প্রেরিত লোক ফিরে এসে জানায় বঙ্গবন্ধুর বাড়ীর সামনে পুলিশ নিহত হয়ে পড়ে রয়েছে। বাড়ীতে কোন লোকজন নেই। পরস্পর জানতে পেরেছে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে। আর মুসা সাহেবের বাড়ীতে খোঁজ করে জানা গেল, ডঃ কামাল হোসেন সেখানে পৌঁছুতে সমর্থ হননি।

 সংগ্রাম কমিটির এই অফিসে চারদিক থেকে বিচ্ছিন্নভাবে খবর আসছে। মানুষের মুখে মুখে খবর প্রচার হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেল শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুল রাজ্জাক, তোফায়েল আহমদ প্রমূখ নদী পার হয়ে জিনজিরার দিকে চলে গেছেন। শেখ কামাল ও শেখ জামাল বাসা থেকে পালিয়ে গেছে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান প্রমুখ নেতৃবৃন্দের কোন খোঁজখবর জানতে পারলাম না।

 কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা এ স্থান ত্যাগ করব। সেখানে জমায়েত নেতাকর্মীদের বললাম, সংগ্রামকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে দিতে হবে। আমরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক বেরিয়েছি। তারা সময়ে সময়ে নির্দেশ পাবে।