পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৮৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৬৩

 পথ চলতে চলতে এক সময় বেলা পড়ে গেল। সামনে নদী। এই নদী পার হলে নবাবগঞ্জ থানা পার হয়ে আমরা দোহার থানায় যাব। খেয়া নৌকায় লোকজনকে পার করে দেয়া হচ্ছে। তবুও নদীর দু’ধারেই মানুষের ভিড়। তবে মানুষকে পার করে কেউ কোন পয়সা নিচ্ছে না। আশেপাশের মানুষ নিজেদের নৌকা দিয়ে ভাগ্যাহত জনতাকে পার করে দিচ্ছে। আমরাও অন্যান্য যাত্রীর সাথে একটি নৌকায় পার হই। নৌকাওয়ালা পয়সা নিতে রাজী হলো না।

 ওপারে নেমেই দেখি একজন যুবক দাঁড়িয়ে। আমাদেরকে জড়িয়ে ধরল। সে যেন আনন্দে আত্মহারা। যুবক মোটর সাইকেল নিয়ে এসেছে। সে বলল, আপনাদের নেয়ার জন্যই আমরা এখানে অপেক্ষা করছি।

 মোটর সাইকেলে দুইজনের বেশী ওঠা যায় না। প্রথমে তাজউদ্দিন ভাইকে নিয়ে গেল তার গ্রামে। আমি হাঁটতে থাকি। পরে আমাকেও নিয়ে গেল। সে গাঁয়ে আওয়ামী লীগের এক বিশিষ্ট নেতার বাড়ীতে আমাদের থাকার ব্যাবস্থা হলো। স্বাভাবিকভাবেই আমরা ক্ষুৎপিপাসায় কাতর। বাড়ীর সামনে পানি ভরা পুকুর। সন্ধ্যা হওয়া সত্ত্বেও দু’জনে গোছল করি। এরপর বৈঠকে বসি। ইতিমধ্যে এই বাড়ীতে অনেক লোক জমা হয়ে গেছে। স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সাথে বিস্তারিত আলোচনা শেষে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়া হলো।

 আহার শেষে দু’জন এক চৌকিতেই ঘুমাতে যাই। পরদিন ভোরে আমাদের যাওয়ার জন্য ২টি মোটর সাইকেলের ব্যবস্থা করা হয়। আমাদের অবস্থান থেকে পদ্মার দূরত্ব ৫০ মাইল। মোটর সাইকেলযোগে রওয়ানা হয়ে রোদ উঠতে না উঠতে আমরা সুবেদ আলী এম পি এ’র বাড়ীতে পৌঁছি। সুবেদ আলী টিপু ব্যারিষ্টারী পড়তে বিলেত গিয়েছিলেন। বিলেতে থাকাকালে তার সাথে আমার পরিচয়। তিনি একজন উৎসাহী দলীয় সদস্য।

 এই বাড়ীতে আমরা আবার বৈঠকে বসি। সেখানে কৃষক নেতা জিতেন বাবুর সাথে দেখা হলো। তিনি ন্যাপ-এর সদস্য। ঘণ্টাখানেক পরে আমরা আবার যাত্রা করি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা অপর একজন এম,পি এ আশরাফ চৌধুরীর বাড়ীতে পৌঁছে যাই। গৃহস্বামী মাত্র ১ ঘণ্টা আগে বাড়ী পৌঁছেছেন। তিনি ২৫শে মার্চের কাল রাতে ঢাকায় ছিলেন। বিরাট দ্বিতল বাড়ী। পানি এসে স্নানের ব্যবস্থা করা হয়। এখানে কিছু খেয়ে আবার পথ চলা শুরু করি। পথ দেখাবার জন্য স্কুলের একজন বাঙ্গালী দফতরী আমাদের সাথে রয়েছেন। পদ্মার তীরে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। প্রমত্ত পদ্মার বুকে তখন প্রচণ্ড ঢেউ। কয়েকটি নৌকা তীরে বাঁধা রয়েছে। বহু অনুরোধ সত্ত্বেও কোন নৌকা আমাদের ওপারে নিয়ে যেতে সাহস পেল না। অগত্যা তীর থেকে আমরা আগারগাঁও নামক একটি গ্রামে ফিরে এলাম। আমাদের দলীয় একজন কর্মী-বন্ধুর বাড়িতে রাত্রি যাপন করি।

 বাড়ীর লোকেরা তাঁতের কাজ করে খায়। স্নান করে খেতে যাব, হঠাৎ স্বাধীন বাংলা বেতারের আনুষ্ঠান কানে ভেসে আসলো। ঘোষক বেতারে বলছেন, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে হাজির হতে বেতারে নির্দেশ দেয়া হলো। প্রথমে এদের নাম-ধাম কিছুই বুঝা গেল না। ঠাওর করে উঠতে পারলাম না, কারা কোত্থেকে এই বেতার চালাচ্ছে। পরে বেতারে মেজর জিয়ার কণ্ঠ শোনা গেল। তিনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান।

 মেজর জিয়ার আহ্বান বেসামরিক, সামরিক তথা বাংলার সর্বশ্রেণীর মানুষকে সংগ্রামে উজ্জীবিত করে। পরদিন এই বেতার থেকে টিক্কা খানের আহত হবার খবর শুনি। তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের অনেক খবর প্রচার করা হয়।

 আমরা দু’জন গভীরভাবে উপলব্ধি করলাম যে অবিলম্বে একটি সরকার গঠন করা প্রয়োজন। পরদিন ভোরবেলা আবার রওয়ানা হই। পদ্মা তখন শান্ত। মাঝ নদীতে চর পড়েছে। আমাদের তাই দুই অংশে পার হতে হবে। আমাদের সাথে আশরাফ আলী চৌধুরীর স্কুলের পিওন রয়েছে।