পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৬৮

রুস্তমজী এক সময় ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর নিরাপত্তা প্রধান ছিলেন। নেহেরু পরিবারের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর খুবই আস্থাভাজন।

 এদিকে আমাদের কাপড় চোপড়ের অবস্থা একেবারেই শোচনীয়। গাড়ীতেই শুরু হয় আলোচনা। রুস্তমজীর প্রথম প্রশ্ন ছিল বঙ্গবন্ধু কোথায়? মজুমদারের প্রথম প্রশ্নও ছিল এটাই। এর পরেও আরো অনেকের সাথে দেখা হয়েছে সকলেরই প্রথম প্রশ্ন ছিল বঙ্গবন্ধু কেমন আছে? এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমরা তৈরী ছিলাম। দলীয় নেতৃবৃন্দ, মুক্তিযোদ্ধাসহ সকলের সাথে বঙ্গবন্ধুর অবস্থানের ব্যাপারে আমরা একই উত্তর দিয়েছি। আমরা যা বলতে চেয়েছি তা হলো বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আমরা তার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ পাচ্ছি। তিনি জানেন, আমরা কোথায় আছি। তিনি আমাদের দায়িত্ব ভাগ করে নিয়েছেন। সময় হলে বা প্রয়োজন দেখা দিলে, তিনি উপযুক্ত স্থানে আমাদের সাথে দেখা করবেন।

 একটি সুন্দর বাড়ীতে (আসাম হাউজ) আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হলো। একটি ঘরে আমি আর তাজউদ্দিন ভাই, অন্য ঘরে রুস্তমজী। আমরা খুবই ক্লান্ত। স্নান করা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের সাথে অতিরিক্ত কোন কাপড় নেই। রুস্তমজী আমার পরিধেয় বস্ত্রের অভাবের কথা জেনে তার ইস্ত্রি করা পায়জামা ও কোর্তা দিলেন। ছ’ফুট লম্বা মানুষের কোর্তা সামাল দেয়া আমার পক্ষে কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়।

 তখন প্রায় মধ্যরাত। স্নানের কাজ সেরে নিলাম। এত রাতে খাবার পাওয়া কষ্টকর, তবুও গোলক মজুমদার আমাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করেন। খাওয়ার পর টেবিলের ওপর রাখা একটি মানচিত্রের দিকে আমরা চোখ রাখি। কোনদিন যুদ্ধ করিনি বা এর কথা ভাবিনি। অথচ আজ যুদ্ধের পরিকল্পনায় অংশ নিতে হচ্ছে। রুস্তমজী রণকৌশলী। আমাদের মূল উদ্দেশ্য তাকে জানালাম। আজ রাতেই আমাদের অনেকগুলো সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

 আমাদের প্রথম কাজ হলো দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা রাজনৈতিক নেতাদের একত্রিত করে তাদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসা। আর দ্বিতীয় কাজ হলো, মুক্তিযুদ্ধকে সংঘবদ্ধ ও সুসংহত করা। বিএসএফএর বিভিন্ন প্রধানদের এই গভীর রাতে ডাকা হয়। তার যোগাযোগ প্রধানের সাথে এই রাতেই যোগাযোগ করা হলো। আওয়ামী লীগের এমএলএএমপিসহ নেতাদের একটি তালিকা তৈরি করে। এতে তাদের সম্ভাব্য অবস্থানের কথা উল্লেখ করা হয়। এসব নেতার সাথে যোগাযোগের জন্যে এই তালিকা বিভিন্ন সীমান্ত ফাঁড়িতে প্রেরণ করা হয়। আমরা বিশেষ ক’জন দলীয় নেতার কথা জানালাম যাদের সাথে আমাদের সহসাই যোগাযোগ প্রয়োজন। যশোর সেনানিবাস অবরুদ্ধ, কুষ্টিয়াতে আমরা জয়লাভ করেছি এবং চুয়াডাঙ্গাতেও আমাদের শক্ত ঘাঁটি হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে অতি দ্রুত আমাদের সুসংবদ্ধ হয়ে উঠতে হবে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আমাদের এই খবর পৌঁছে দেয়া প্রয়োজন। বিএসএফ-এর মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাসহ নেতৃবৃন্দের কাছে নির্দেশ পৌঁছে দেয়া শুরু করি।

 যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের যথাসম্ভব সাহায্য দিতে বিএসএফ রাজী হলো। পরামর্শ করতে রাত প্রায় শেষ হয়ে গেল। ভোরের দিকে কিছুক্ষণের জন্য আমরা বিছানায় যাই। ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে গিয়ে রেডিওর শব্দ শুনি। বিএসএফ-এর চট্টপাধ্যায় এই রেডিও দিয়েছিলেন। রেডিওতে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পাক হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের কাহিনী শুনি। আমাদের মা-বোনদের ওপর বর্বর অত্যাচারের কথা শুনে মনের অজ্ঞাতেই বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মত দু-চোখ বেয়ে অশ্রু নেমে এলো।

 বিএসএফ আমাদের আতিথেয়তার ভার নেয়। চট্টপাধ্যায়ের সাথে পরিচয় হয়ে গেছে। ৯মাস আমাদের সাথে বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে কাজ করেছেন। আমাদের সিদ্ধান্তগুলো কার্যকরী করার দায়িত্ব ছিল তার ওপর। একজন বিদেশী রাষ্ট্রের কর্মচারী হয়ে এমন নিষ্ঠার সাথে কাজ করেও তিনি কোন দিন কোন কৃতিত্বের দাবী করেননি। মিঃ চট্টপাধ্যায় আমার জন্য একটি প্যাণ্ট ও একটি শার্ট যোগাড় করলেন।