পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৯৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৭০

 এটা ছিল একটা পুরনো রাশিয়ান বিমান। এর শব্দ ছিল বিকট। বিমানের যাত্রা শুরু হল। সমস্ত ককপিট কাঁপছে। তাজউদ্দিন ভাই বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করেও ওভাবে বসে থাকতে পারলেন না। দিল্লী পৌঁছতে রাত শেষ হয়ে যাবে। কিছুক্ষণ পর একটা কেনভাস বিছিয়ে আমি ও তাজউদ্দিন ভাই মেঝেতে শুয়ে পড়ি। গরমে আমরা ঘামছিলাম। বিমানের কাঁপনের সাথে আমাদের শরীরও কাঁপছিল। এমনি করে আধা ঘুমে আধা জেগে ভোরের দিকে আমরা দিল্লী পৌঁছি। সেখানে মিলিটারী বিমান বন্দরে আমাদের জন্য একটি গাড়ি প্রস্তুত ছিল। একজন কর্মকর্তা আমাদের নিয়ে গেলেন। চট্টপাধ্যায় আমাদের সাথে ছিলেন। মজুমদার গেলেন তাঁর মেয়ের বাসায়। প্রতিরক্ষা কলোনীর একটি বাড়িতে আমাদের রাখা হলো। পরে জেনেছি বাড়িটি ছিল বিএসএফ-এর একটি অতিথিশালা। এ বাড়ীতে অন্য আর কেউ নেই। আমি ও তাজউদ্দিন ভাই এক ঘরে, চট্টপাধ্যায় অন্য ঘরে। আমাদের দুটি বিছানা রয়েছে। ঢাকা থেকে বেরোবার পর থেকে দু’জন একত্রেই থাকছি। এতে সুবিধা অনেক। রাতে ঘুম না আসা পর্যন্ত সব কিছু পর্যালোচনা করার সুযোগ পাই। গোলক মজুমদার ও রুস্তমজী ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আমাদের একটি বৈঠকের ব্যবস্থা করার কাজে লিপ্ত রয়েছেন। আমাদের কিন্তু বিলম্ব সইছে না। ইতিমধ্যেই দিল্লীর বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা প্রশ্ন তুলেছে যে মোহম্মদ আলী প্রকৃতই তাজউদ্দিন আহমেদ এবং রহমত আলী ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম কিনা।

 ভারতের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার আচরণে কখনো অবাক হয়েছি আবার কখনো ভীত হয়েছি। তবে ‘র’ RAW নামক একটি গোয়েন্দা সংস্থা মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজেদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় খুবই ব্যস্ত ছিল। এই সংস্থাটির কার্যকলাপে কখনই আমি সন্তুষ্ট হতে পারিনি। কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন আমাদের সাথে আলাপ করে। তারা নিশ্চিত হতে চায় আসলেই আমরা আওয়ামী লীগের লোক কিনা। তাদের আলোচনার পর সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার মিঃ কউলের কিছুটা বিশ্বাস জন্মে যে সত্যিই আমরা আওয়ামী লীগের লোক।

 মেজর ওসমানের অস্ত্রের তালিকাটা তখনো আমার পকেটে। কথায় কথায় মিঃ মীরন আমাদের জানান যে, আলোচনার মাধ্যমে অস্ত্র পেতে আমাদের বিলম্ব হবে। মিঃ মীরনের কাছে আরো জানতে পারি, লণ্ডনে মিনহাজ উদ্দিনের সাথে তাদের কথা হয়েছে। আমাদের কোন খবর থাকলে তিনি তা পৌঁছে দিতে পারেন।

 মিনহাজ আমার পূর্ব পরিচিত। আমি তাকে চিঠি লিখি। আমি চিঠিতে অস্ত্রের একটা তালিকা পাঠাই। তাকে জানাই, লণ্ডনস্থ বাঙ্গালীরা ইচ্ছা করলে আমাদের জন্য অস্ত্রের ব্যবস্থা করতে পারে। তখনো বুঝে উঠতে পারিনি। অস্ত্র কেনা ও তা সরবরাহ করা তত সহজ নয়।

 ইতিমধ্যে আমরা খবর পেলাম, রেহমান সোবহান ও ডঃ আনিসুর রহমান দিল্লীতে পৌঁছেছেন। তাছাড়া এমআর সিদ্দিকী, সিরাজুল হক বাচ্চু মিয়া ও যুবনেতা আবদুর রউফ তখন দিল্লীতে ছিলেন। তাদের সকলের সাথে আলাদা আলাদাভাবে আমাদের বৈঠক হয়। এমআর সিদ্দিকীর কাছে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ও নোয়াখালী অঞ্চলের মোটামুটি কিছু খবর পাই। তার কাছে চট্টগ্রামের কালুর ঘাট বেতার থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠের কাহিনীও শুনি। তিনি জানান, মেজর জিয়া একটা জীপে করে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতারা এক প্রকার জোর করে জিয়াকে দিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠ করান। তিনি আরো জানান চট্টগ্রাম থেকে তারা একটি ট্রান্সমিটার আগরতলাতে নিয়ে এসেছেন। এবং তা দিয়ে প্রচার কাজ চালানো হচ্ছে। ত্রিপুরা রাজ্য সরকার ও জনগণ তাদেরকে সর্বপ্রকার সাহয্য করেছেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন। একটি সরকার গঠন করার জন্য তিনি আমাদের অনুরোধ জানান। কর্মীদের প্রতি শুভেচ্ছা নিয়ে তিনি আগরতলা চলে যান। তবে তাকে সরকার গঠন করার ইঙ্গিত দিয়ে দিলাম। আবদুর রউফকে নির্দেশসহ রংপুর পাঠিয়ে দেই।

 এ সময় ময়মনসিংহ থেকে রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া ও সৈয়দ আবদুস সুলতানের চিঠি পেলাম। সৈয়দ সুলতান বাংলাদেশের পক্ষে জাতিসংঘে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।

 এমনিভাবে দিল্লী আসার পর ২দিন কেটে গেল। ইতিমধ্যে রুস্তমজী ও গোলক মজুমদার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করেছেন। আমরা তাদের দু’জনকে এ কথা বুঝাতে সক্ষম হই যে, বাঙ্গালী হলেও আমাদের