পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৯৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৭২

 তাজউদ্দিন ভাই নিষ্ঠাবান ও সংগ্রামী পুরুষ। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দল ও দেশের স্বার্থে কাজ করতেন। নিজে বেশির ভাগ কাজ করেও তিনি কৃতিত্বের দাবি করতেন না। সকল কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে তিনি নিজেকে সর্বদাই দূরে রাখার চেষ্টা করেছেন। তাই আমি যখন বিপ্লবী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার জন্য তার নাম প্রস্তাব করি তখন এই প্রস্তাব মেনে নিতে তাঁর খুবই কষ্ট হচ্ছিল। এই দায়িত্বের গুরুভার সম্পর্কেও তিনি সচেতন ছিলেন। এই অবস্থায় তিনি আবার আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কথা স্মরণ করেন। তাঁরা কে কোথায় কি অবস্থায় আছেন, এ নিয়ে তিনি বিশেষভাবে চিন্তা করছেন। পত্রিকাতে ইতিমধ্যে অনেকের মৃত্যু সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। অবশ্য পত্রিকাতে নিহতের তালিকায় তাজউদ্দিন ভাই এবং আমার নামও রয়েছে।

 নিহতের তালিকায় আমাদের দু’জনের নাম দেখে ভেবেছিলাম, আমাদের নেতারও হয়তো জীবিত রয়েছেন। আমাদের আর একটি চিন্তা হলো বঙ্গবন্ধুকে সরকারের প্রধান করা হলে আমাদের আন্দোলনের ব্যাপারে কি প্রতিক্রিয়া হবে। অথবা তার জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার কারণ দেখা দিবে কিনা। এ নিয়ে দু’জনে অনেক রাত পর্যন্ত আলোচনা করি। পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি দেই আবার খণ্ডন করি। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলাম, ফলাফল যাই হোক, বঙ্গবন্ধুকে সরকারের রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করতে হবে।

 তাজউদ্দিন ভাই বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে বঙ্গবন্ধুর সহকর্মী হিসেবে তাঁর সাথে কাজ করেছি। তবে এই ব্যাপারে আমি স্থির নিশ্চিত যে কোন প্রকার ভয় ভীতি বা চাপের মাধ্যমে পাক সরকার বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কোন বিবৃতি দিতে সমর্থ হবে না।

 আমরা যেহেতু একটি যুদ্ধে লিপ্ত ছিলাম এবং বঙ্গবন্ধু তখন শত্রুর কারাগারে বন্দী কাজেই সে সময় আমাদের সব কিছুই ভাবতে হয়েছিল। তাছাড়া ভাবাভাবির বেশি সময়ও ছিল না। কেননা আমাদের ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন। একটা সরকার গঠন করা ছাড়া কাজে এগুনো যাচ্ছে না। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সিপাহসালার শত্রুর হাতে বন্দী। আবার তাকে বাদ দিয়ে যে মুক্তিযুদ্ধের কথা কল্পনাও করা যায় না।

 তারপর কথা উঠলো দেশের নাম কি হবে। আমি বললাম, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ তাজউদ্দিন ভাইএর পছন্দ হলো। নামটি ঠিক করার সময় আমাদের মাথায় গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের কথা মনে হচ্ছিল। এ সময় সরকারী কাগজপত্র ব্যবহারের জন্য একটি মনোগ্রাম ঠিক করা দরকার। মনোগ্রাম আমাদেরই ঠিক করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের যে মনোগ্রাম সরকারী কাগজপত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে, তা আমার হাঁতে আকা। চারপাশে গোলাকৃতি লাল-এর মাঝখানে সোনালী রং-এর মানচিত্র। মনোগ্রাম দেখে তাজউদ্দিন ভাই পছন্দ করলেন। শুধু তাই নয়, সাথে সাথে তিনি তা অনুমোদনও করেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এটি তাঁর প্রথম সরকারী অনুমোদন।

 এই দিন সন্ধ্যার পর রেহমান সোবহান ও ডঃ আনিসুর রহমান আমাদের সাথে দেখা করতে এলেন। রেহমান সোবহান এর আগে একবার দেখা করে গেছেন। এ সময় আনিসুর রহমান স্বচক্ষে দেখা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাক বাহিনীর নারকীয় হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দেন। তিনি নিজের বাসার গেটে তালা ঝুলিয়ে অন্যদিক দিয়ে বাসায় ঢুকে স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে নিয়ে বাসার মেঝেতে শুয়ে রাত কাটান এবং জানালা দিয়ে সেই নারকীয় হত্যাকাণ্ড দেখেন। পাক দস্যুরা তার বাসার গেটে দরজা দেখে চলে যায়। সারাদিন আমি তাজউদ্দিন ভাই-এর বক্তৃতা তৈরী করছি। রেহমান সোবহান বক্তৃতার খসড়া রচনায় আমাকে সহায়তা করেন। সেদিনই তার কাছে জানতে পারি যে, ডঃ কামাল হোসেন গ্রেফতার হয়েছেন। রেহমান সোবহান জানান, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করবেন। তাঁর ইংরেজী খসড়ার একটা অংশ আমার খুব ভাল লেগেছিল। সেটা ছিল “Pakistan is dead and buried under mountain of Corpses” বাংলায় এর অনুবাদ করি পর্বত প্রমাণ লাশের নিচে পাকিস্তানের কবর রচিত হয়েছে। শেষ অনুচ্ছেদ আমি লিখি। ‘আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধা, ছেলেদের রক্ত ও ঘামে মিশে জন্ম নিচ্ছে নতুন বাংলাদেশ।’ এক সময় চোখের জলে বক্তৃতার খসড়ার এক অংশ ভিজে গেল। চোখ মুছে আবার লিখতে শুরু করি। লেখা শেষ হলে সমস্ত বক্তৃতাটা তাজউদ্দিন ভাইকে শোনাই।