পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৯৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৭৩

 রাজনৈতিক খসড়া প্রণয়নে তাজউদ্দিন ভাই খুবই দক্ষ। কোন একটি খসড়া করার পর তিনি মনোযোগ দিয়ে শুনতেন, মাথা নাড়তেন, কোন স্থানে থেমে নিজের বক্তব্য স্পষ্ট করে বলতেন। প্রয়োজনবোধে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করতেন। এমনিভাবে চূড়ান্ত বক্তব্য তৈরী হতো। আমাদের দু’জনের মন ও চিন্তা যেন একইভাবে কাজ করছিল।

 আমার হাতের লেখা খুব ভাল নয়। তাজউদ্দিন ভাই-এর বক্তৃতা টেপ করতে হবে। আমি একটি টেপ রেকর্ডারের ব্যবস্থা করি। তিনি সমস্ত বক্তৃতা নিজের হাতে লিখে নিলেন। চট্টপাধ্যায় তার নিজের হাতে আরো একটা কপি করে নেন। তখন তিনজনের হাতে বক্তৃতার তিনটি কপি হয়ে গেল। পরদিন তাজউদ্দিন ভাই দ্বিতীয়বারের মত ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করেন। ইন্দিরা গান্ধী জানান, বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করে পাকিস্তান নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অবশ্য এই খবর পাকিস্তান সরকার তখনো সরকারীভাবে প্রকাশ করেনি।

 ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে তাজউদ্দিন ভাই বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময় করেন। সিদ্ধান্ত হয় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার ভারতের মাটিতে অবস্থান করতে পারবে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, তাদের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ এবং শরণার্থীদের আশ্রয় ও খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের খবরা খবর প্রচারের জন্য একটি বেতার স্টেশন স্থাপনের বিষয়ও আলোচনা হয়।

 এদিকে আমাদের নেতারা যে কোথায় আছেন সে খবর আমরা এখনো জানি না। তাঁদের খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য একটি ছোট বিমানের ব্যবস্থা করা হলো। স্বাধীনতা যুদ্ধে সহায়তা করার জন্য ভারত সরকার একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলকে আমাদের সাথে দেন। ঐ জেনারেলের নাম নগেন্দ্র সিং। তাঁর বয়স ৬০এর ঊর্ধ্বে। তিনি সামরিক ব্যাপারে আমাদের পরামর্শ দেবেন। জেনারেল সিং মনে-প্রাণে একজন খাঁটি সৈনিক। ব্যক্তিগত জীবনে খুবই ধর্মপ্রাণ। তাছাড়া মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন মানুষ। আমাদের সংগ্রামের প্রতি তিনি আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধাশীল। দিল্লীতে বসেই তাজউদ্দিন ভাইয়ের বক্তৃতা টেপ করা হয়। বক্তৃতার পূর্বে আমার কণ্ঠ থেকে ঘোষণা প্রচারিত হয় এখন তাজউদ্দিন আহমদ জাতির উদ্দেশে বক্তৃতা দেবেন। এরপর তাজউদ্দিন ভাই বক্তৃতা শুরু করেন।

 আমরা বিমানে করে আবার কলকাতা ফিরে এলাম। এখানে এসে জানলাম মনসুর ভাই ও কামরুজ্জামান (হেনা ভাই) এসেছেন। তাঁদের কথা শুনে কিছুটা স্বস্তি পেলাম। খবর নিয়ে জানলাম কলকাতায় গাজা পার্কের কাছে একটা বাড়িতে কামরুজ্জামান ভাই থাকেন। শেখ ফজলুল হক মনি ঐ বাড়িতে আছেন। পরে আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমদ ও সিরাজুল ইসলাম খান এই বাড়িতে ঘাঁটি করেন।

 আমি ও তাজউদ্দিন ভাই কামরুজ্জামান ভাইয়ের কাছে দেখা করতে গেলাম। আমরা তার কাছে এ পর্যন্ত ঘটনাবলী ব্যক্ত করি। কামরুজ্জামান ভাইয়ের মনে একটা জিনিস ঢুকানো হয়েছে যে আমরা তাড়াহুড়া করে দিল্লী গিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করেছি। নেতাদের জন্য অপেক্ষা করা উচিত ছিল।

 শেখ মনি আমাকে অন্য একটি ঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন। তিনি আমাকে এটা বুঝালেন যে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আমাদের বিলম্বে সাক্ষাৎ হওয়ার করণ হলো তাঁরা এখান থেকে ক্লিয়ারেন্স দেননি। তিনি বুঝাতে চাইলেন তাঁরা একটি শক্তিশালী গ্রুপ এবং তাঁদের সাথে ইন্দিরা গান্ধীর পূর্ব থেকেই যোগাযোগ রয়েছে।

 আমাদের সরকার গঠনের ব্যাপারে সন্তুষ্ট নন এমন অনেক এমপিএ, এমএনএ ও আওয়ামী লীগ নেতা কলকাতায় এসেছেন। প্রিন্সেস স্ট্রীটের এমএলএ হস্টেলে ওঁরা উঠেছেন।

 একটা জিনিস বুঝতে পারলাম আমাদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গেছে। শহরের বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপে আলাপ-আলোচনা চলছে। ইতিমধ্যে কামরুজ্জামান ভাইকে নিয়ে কতিপয় এমপি ও নেতা প্রিন্সেস