পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/১০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

76 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড বাংলাদেশে ইয়াহিয়া আর তার বর্বর সেনাবাহিনীর সামরিক অভিযান শুরু হবার দুদিন আগে পর্যন্ত খান আবদুল ওয়ালী খান ঢাকায় ছিলেন। তিনি বলেন, নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা এবং পাকিস্তানের নতুন সরকার গঠনের একমাত্র অধিকারী তিনিই ছিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়া ও তার সামরিক চক্র তাঁর আইনসঙ্গত অধিকার থেকে তাঁকে বঞ্চিত করেছে। তিনি বলেন, পাকিস্তান নামক কৃত্রিম রাষ্ট্রটিকে টিকিয়ে রাখার যে ক্ষীণতম সম্ভবনা ছিলো, পাকিস্তানী সামরিক চক্র তাকেও বেয়োনেট বিদ্ধ করেছে। পাকিস্তান টুকরো টুকরো হবেই- তাকে কেউ রোধ করতে পারবে না। অথচ এমনটি হয়তো এতো তাড়াতাড়ি ঘটতো না। পাকিস্তানী সামরিক চক্রের মাথায় গোবর বোঝাই না হলে খুব সহজে এমনটি ঘটতো না। তারা যদি জনগণের রায়কে মনে নিত এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যদি দেশের প্রধানমন্ত্রী বলে স্বীকার করে নেয়া হতো তাহলে পাকিস্তানকে আরও কয়েকটা দিন টিকিয়ে রাখা যেতো। কিন্তু তা এখন আর কিছুতেই সম্ভব নয়। গত ২৫শে মার্চের রাতেই ইয়াহিয়ার বর্বর সেনাবাহিনী সেই সম্ভাবনাকে খুন করেছে। পিণ্ডির বর্তমান পরিস্থিতির উল্লেখ করতে গিয়ে খান আবদুল ওয়ালী খান একটি উপমা দিয়ে বলেনঃ ‘দুধের কলসী ভেঙ্গে গেছে। দুধ চারদিকে গড়িয়ে পড়ছে। আর তার চারপাশে বসে তারা কাঁদছে।” পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তিনি বলেনঃ পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ যে কেবল অন্ধকারাচ্ছন্ন তা নয়, বিপজ্জনক। ২১ আগষ্ট, ১৯৭১ ... বাংলাদেশের শহরে নগরে বাজারে বন্দরে প্রতিটি পল্লীতে আজ শত্রহননের দুর্বার লড়াই চলছে। আর এই লড়াইয়ে কুলিয়ে উঠতে না পেরে আমাদের মৃত্যুঞ্জয়ী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে প্রচণ্ড মার খেয়ে পাকিস্তানী সামরিক চক্র নতুন এক ফন্দি আটলো। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে তারা ভারত-পাকিস্তান সমস্যা বলে চিহ্নিত করে কাজ হাসিল করতে চেয়েছিলো। তারা ভেবেছিলো আমাদের দেশের এই মুক্তিযুদ্ধকে তারা যদি ভারত-পাকিস্তান বিরোধ বলে চিহ্নিত করতে পারে তাহলে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি আজ যে বিশ্ব জনমত গঠিত হয়েছে তাকে বিভ্রান্ত এবং বাংলাদেশে আজ যে দুর্বার লড়াই চলছে, তাকে কিছুটা প্রশমিত করা যাবে। পাকিস্তানী সামরিক চক্র এই উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার সীমান্তে এবং ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উস্কানিমূলক তৎপরতা শুরু করলো। কিন্তু বিশ্বের সচতেন মানুষ পাকিস্তানী সামরিক চক্রের এই দুরভিসন্ধিটা বুঝে নিয়েছে। ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকি দিয়ে এমন কি প্রয়োজন হলে সংঘর্ষ একটা বাধিয়ে দিয়ে কাজ হাসিল করার যে দুরভিসন্ধি তারা করেছিলো তা ভন্ডুল হয়ে গেছে। সোভিয়েত প্রধানমন্ত্ৰী মিঃ আলেক্সী কোসিগিন পাকিস্তানী ফ্যাসীবাদী সামরিক চক্রের এই ঘৃণ্য দুরভিসন্ধির কথা জানতে পেরে বাংলাদেশে গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ ও নারী নির্যাতনের নায়ক পাকিস্তানের স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়াকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় হুশিয়ার করে দিয়ে বলেছেনঃ সাবধান ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধানো পাকিস্তানের পক্ষে আত্মহত্যার সামিল হবে। গত ১৭ই আগষ্ট ইসলামাবাদস্থ সোভিয়েট রাষ্ট্রদূত মিঃ এ, এ, রদিনভ জেনারেল ইয়াহিয়ার হাতে সোভিয়েট প্রধানমন্ত্রী মিঃ কোসিগিনের একটি চিঠি পৌঁছে দেন। ওই চিঠিতেই সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানী সামরিক চক্রের গোপন দুরভিসন্ধি ঔদ্ধত্যের বিষয়ে জেনারেল ইয়াহিয়াকে হুশিয়ারী প্রধান করেন। চিঠিতে তিনি ইয়াহিয়া ও তার বর্বর সামরিক চক্রকে অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় এই বলে হুশিয়ার করেছেন যে, তারা যেন গোঁয়ারের মতো ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আস্ফালন বা দায়িত্বজ্ঞানহীন উক্তি না করে। চিঠিতে প্রধানমন্ত্রী আলেক্সী কোসিগিন ইয়াহিয়া আর তার জঙ্গী সামরিক চক্রকে বাংলাদেশে গণহত্যা ও উৎপীড়ন অবিলম্বে বন্ধ করতে এবং শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসনে আর একপা অগ্রসর না হওয়ার জন্যে উপদেশ দিয়েছেন।