পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/১১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড নির্বাচনে কুচক্রী মুসলিম সরকারের অনুসারীগণ বাংলার মাটিতে সাংঘাতিক পরাজয়বরণ করে আবার পর্দার অন্তরালে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করে। এই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের একুশ দফার সপক্ষে সমগ্র বাঙালী অকুণ্ঠ রায় দিয়েছিলেন। বাঙালীর এই একতা ও নবজাগ্রত চেতনা পশ্চিমাদের ভয়ের ও আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়ায় বাংলাকে যেমন নির্বিচারে শোষণ করা চলছিল এবার সে পথে এক বিরাট বিঘ্ন সৃষ্টি হয়ে পড়ে। এই জাগ্রত জনতার পুরোভাগে দাঁড়িয়ে যখন শেরে বাংলা ফজলুল হক ব্ৰজকণ্ঠে ঘোষণা করতে থাকেন যে বাংলাকে আর শোষণ করতে দেয়া হবে না তখন পশ্চিমা আমলাগণ এবং স্বার্থবাদী রাজনীতিবিদরা বিপদ গুনতে শুরু করে। তাই ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার হতে থাকে-আর বাংলার অবিসংবাদিত নেতা ফজলুল হককে বলা হয় বিশ্বাসঘাতক। এই ষড়যন্ত্রের নেতা সেদিন ছিল ইস্কান্দার মির্জা, গোলাম মোহাম্মদ প্রমুখ। এদের সাথে হাত মিলিয়েছিল চুয়ান্নোর নির্বাচনে পরাজিত মুসলিম লীগের কতিপয় বাঙালী মীরজাফর। ১৯৫৫ সালের ২৯ শে মে বাংলার দরদী নেতা শেরে বাংলা ফজলুল হক যখন করাচী থেকে ঢাকা বিমানবন্দরে ফিরে এলেন তখন বিপুল জনতা তাঁকে সংবর্ধনা জানাতে সেখানে সমবেত হয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাসনিজের দেশে ফিরে এসে, যে বাংলার মাটিকে ফজলুল হক প্রাণের মত ভালবাসতেন সেই মাটিতে দাঁড়িয়ে একটি কথা পর্যন্ত বলবার অধিকার তাঁর রইল না। সামরিক বাহিনীর কড়া পাহারায় তাঁকে বিমানবন্দর থেকে গৃহে নিয়ে যাওয়া হোল এবং নিজের ঘরে তাঁকে অন্তরীণাবদ্ধ করে রাখা হোল ছয় মাস তাঁকে বাইরের কোন লোকের সাথে মিশতে দেয়া হোত না। এমনকি পবিত্র ঈদের দিনে মুসলিম জামাতের সাথে একত্রে বসে নামাজ পড়তে পর্যন্ত তাঁকে দেয়া হোত না। বাংলাকে ভালবাসার এই হোল শাস্তি-বাংলার দুঃস্থ, নিঃস্ব, নিপীড়িত এবং বঞ্চিত মানুষের জন্য কথা বলার এই হোল সত্যিকার পুরস্কার। ঋণ সালিসী বোর্ড স্থাপন করে একদিন যে ফজলুল হক বাঙালীর অস্তিত্ব রক্ষা করতেন, বাংলার গ্রামে, বন্দরে, শহরে অসংখ্য স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষার পথ যিনি সুগম করেন এবং সর্বোপরি লাহোর বৈঠকে যিনি সারা বিশ্বের সামনে পাকিস্তান প্রস্তাব তুলে ধরেন সেই ফজলুল হক, সেই শেরে বাংলা ফজলুল হক সেদিন প্রবীণ ও বৃদ্ধ বয়সে নিজের ঘরে বন্দী হয়ে রইলেন। যেদিন জীবনের সমস্ত বিশ্বাস ও আরাম-আয়েশ পরিত্যাগ করে দেশের স্বাধীনতার জন্য ফজলুল হক ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সেদিন কোথায় ছিল ইস্কান্দার মির্জা, গোলাম মোহাম্মদ? বৃটিশের তাঁবেদার ও গোলাম সেজে তারা তখন চাকরি করতো ও নিজেদের সমস্ত বিপদ থেকে নিরাপদ দূরত্বে বাঁচিয়ে রেখে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ওপর রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করতো এই দুই পরাশ্রিত বশংবদ জানোয়ার। আর পাকিস্তান বলতে এদের এতটুকু বাধলো না।... উনিশ শ’ সত্তরের নির্বাচনের পর এসেছে অভিশপ্ত একাত্তর সাল। এবারেও সেই একই খেলার ভয়াবহ পরিণাম আমাদের চোখের সামনে প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে। চুয়ান্নোর নির্বাচনের পর শিকার ছিলেন শেরেবাংলা ফজলুল হক, প্রবীণ গণনেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও অসংখ্য দেশপ্রেমিক। শিকার ছিলেন শহীদ সোহরাওয়াদী এবং সেদিনের তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। আর আজকের নির্বাচনের পর শিকার হয়েছেন বাংলার অবিসংবাদিত প্রাণের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর অনুসারীবৃন্দ এবং বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। যে ইয়াহিয়া, টিক্কা এবং এম, এম, আহমেদ একদিন ছিল বৃটিশের পদলেহী চাকর, যারা স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় ছিল এক-একটি অখ্যাত-কুখ্যাত সাধারণ গোলাম, আজ তারাই হয়েছে দেশের হর্তাকর্তা-বিধাতা। আর ফজুলল হকের ভাগ্যে যেমন জুটেছিল বিশ্বাসঘাতকতার গ্রানি, তেমনি বাংলার প্রাণের নেতার সমগ্র পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের একমাত্র গণনেতা আজ হলেন দেশদ্রোহী। ভাগ্যের এ এক নির্মম পরিহাস বটে-রবীন্দ্রনাথের উপেনের ভাষায় “তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ আর আমি চোর বটে।” কিন্তু দিন আর বেশী দূরে নয় যখন এই ষড়যন্ত্রের জাল আমরা ছিন্নবিচ্ছিন্ন করবোই এবং বাং এই দানবদের নির্যাতন থেকে উদ্ধার করবোই। আসুন আপনি কৃষক-মজুর, আসুন আপনি চাকরিজীবীবুদ্ধিজীবী, সবার ওপর এসো তোমরা ছাত্র-ছাত্রী, যুবক-তরুণের দল এবার আমরা দানব হত্যায় ও দানব বিতাড়নের