পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/১১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

90 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড পাচ্ছেন না। সুতরাং পাকিস্তানের জঙ্গী শাসক চীৎকার করে যতই বলুক যে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে কিন্তু আসলে যে তা সত্য নয় একথা আমরা সবাই জানি। আর আমরা বাঙালী একথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে বাংলাদেশকে যতদিন পর্যন্ত না হানাদার পশ্চিম পাকবাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করা যাচ্ছে, ততদিন দেশে স্বাভাবিক অভস্থা ফিরে আসতে পারে না। সত্যিকারভাবে বাংলায় বিগত তিনমাসে যা ঘটেছে তারপর আর কোন অবস্থায়ই এই হানাদার পশুশক্তির সাথে সহযোগিতা করতে একটি বাঙালীও অগ্রসর হতে পারেন না। জোর করে কিছুসংখ্যক লোককে অফিসে, আদালতে, ট্রেনে, বাসে বা শহরে-নগরে নিয়ে এলেও বাংলার মানুষের মন জয় করবার সাধ্য এই পশুশক্তি চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলেছে। আর তাদের বর্বরতা, তাদের ইতিহাসে নজীরবিহীন হত্যালীলা, পাশবিকতা ইত্যাদি কার্যকলাপের মাধ্যমে পাকিস্তান নামক দেশটি মৃত্যুবরণ করেছে-আর সেখানে জন্ম নিয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। আমাদের প্রিয় জন্মভূতি বাংলাদেশ। জয় বাংলা। (চেনাকণ্ঠ" ছদ্মনামে ডঃ মযহারুল ইসলাম রচিত) ২৬ জুন, ১৯৭১ বাংলাদেশ ও নাম কানের ভিতর দিয়া মরমে পশে এ নামের লাবণী অবনি বহিয়া যায়। আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি। শেখ মুজিবের বড় প্রিয় গান। সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর প্রাণের গান। এ গানে বাংলাদেশের মর্মকথাটি আছে। আমার কাছে এ গানের কিন্তু একটা ভিন্ন অর্থ আছে। মনে পড়ছে গাঁ থেকে ফিরছি। অদূরে রাজশাহী শহর দেখতে পাচ্ছি। তেসরা এপ্রিল। সকাল দশটা। মাথার ওপরে উড়ে এলো ইয়াহিয়া খানের জল্লাদ বিমান স্যাবর জেট। তারপর শুরু হলো নির্মম বোমা বর্ষণ। আমি তাড়াতাড়ি একটা খালে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু খালটার দশহাত দূরেই একটি ছেলে হাল চাষ করছে। তাকেও শুয়ে পড়তে দেখলাম। কিন্তু সে নির্বিকার হাল চাষ করতে লাগলো। কোন কিছুই হয়নি। বিমানগুলি চলে গেলে আমি উঠে দাঁড়িয়ে কাপড়-চোপড় ঝাড়তে লাগলাম। কিন্তু ছেলেটি তখন গাইছে, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি। আমাকে দেখে ও বলদ দুটি থামালো-বললো, আপনি বুঝি খুব ভয় পেয়েছিলেন? তার কথায় একটু বিদ্রুপের সুরও ছিল। বললাম, হ্যাঁ ভয় একটু পেয়েছিলাম বৈকি। বললাম, তোমার বুঝি ভয় করেনি। বললো, না। বললো, মরতে তো হবেই স্যার। জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমার নামটি কি ভাই? উত্তর এলো, অমল। ঘটনাটা ছোট্ট কিন্তু অসামান্য। অমল, বিমল, রহিম, করিম হাল-চাষ করছে আর গান গাইছে, আমার সোনার বাঙলা আমি তোমায় ভালবাসি। অতন্দ্র প্রহরী এই ই-পি-আর বাহিনীর জোয়ানেরা। ওদের কাছে বসলাম। পাশেই বাজছে রেডিও। আবার গানঃ আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি। ই-পি-আর এর কয়েকজন জোয়ান গানের সঙ্গে পায়ের তাল ঠুকছে। ওরই মধ্যে একজন, নাম রশিদ। ঢাকায় বাড়ি, বললো, কি জানেন সাহেব, এ গানটা শুনলেই পরানটা এক্কেবারে ফাইট্যা যাবার চায়। বললো ঐ যে ছেলেটাকে দেখছেন, ঐ যে হাল চাষ করছে। ওর নাম অমল। কাল সারা রাত ট্রেঞ্চ কেটেছে আমাদের জন্য। আর এই যে দেখছেন বুড়ো মিয়াকে, ইনি মসজিদের ইমাম। সারাদিন আমাদের জন্য খাবার দিয়ে যাচ্ছে। পানি আনছেন। বিড়ি-সিগারেট জোগাড় করছেন। বুকটা আমার গর্বে ফুলে উঠলো। বাংলাদেশের মানুষ জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে শেখ মুজিবের আহবানে সাড়া দিয়েছেন। হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের এমন প্রমাণ আর কখনও দেখিনি... (অধ্যাপক আব্দুল হাফিজ রচিত)