পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/১১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

92 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড দুনিয়ার মানুষের মনে? তবু, যাদের মাথায় দুবুদ্ধি ভর করেছে, যাদের মাধ্যমণি হিসেবে ইয়াহিয়া খান ধরাকে সরা জ্ঞান করেছে, তারা এই রেডিও গলাবাজির আগে একটা অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্যে বাজনা তো কম দেশদেশান্তরে মিষ্টি কথা তো কম পরিবেশন করেনি। পাকিস্তানী শাসকচক্রের ঝানু ঝানু উপদেষ্টারা ইতিমধ্যে তদ্বির-তদারকের বাকি কিছু রাখেনি। কিন্তু কোন ফল হলো না। ইয়াহিয়া খানের ২৮ শে জুনের রেডিও ভাষণ একটা জঘন্য অপভাষণ হিসেবেই বরং চিহ্নিত হয়ে গেল। উলঙ্গ হয়ে ধরা পড়ে গেলে রাওয়ালপিণ্ডি সামরিকচক্রের সেই মুনাফালোভী দুবুদ্ধিতা, যা এই চক্রকে বাংলাদেশ দমনে প্রবৃত্ত করেছে। ইয়াহিয়া খান তার প্রলাপে বলেছে যে, রাওয়ালপিণ্ডির সামরিক চক্র নিজেরাই শাসনতন্ত্র রচনা করবে। তারা পশ্চিম পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরও শাসনতন্ত্র রচনার এখতিয়ার নাকচ করে দিয়েছে। বাংলাদেশকে তো তারা ধ্বংস করতেই চেয়েছে। এটা ইয়াহিয়ার কারণে দুনিয়ার কাছে জাহির হয়ে গিয়েছে। ২৮শে জুনের আগে দুনিয়ার যেসব রাষ্ট্রের কর্মকর্তারা চিন্তা করছিলেন যে, দাবনীয় অপকর্ম করে ফেলে হাতেনাতে ধরা পরে ইয়াহিয়া খানেরা হয়তো তওবা করে পশ্চিম পাকিস্তানে বহাল থাকার জন্যেও দুনিয়ার কাছে একটা সম্মানজনক মীমাংসাসূত্র রাখতে পারবে, তারাও খুঁজে পেতে কিছু পায়নি ইয়াহিয়া খানের বাচনে। বস্তুতপক্ষে ২৮শে জুনের পরে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মুখপাত্র এবং প্রতিনিধিবৃন্দ বাংলাদেশের ঘটনা সম্পর্কে যেসব বক্তব্য বলেছেন, তাদের প্রত্যেকটি থেকেই একথা বুঝতে পারা যায় যে, এইসব মুখপাত্র এবং প্রতিনিধি ইয়াহিয়া খানের বাচনকে আমলেই আনেননি। নিউজিল্যাণ্ডের প্রধানমন্ত্রী এবং পশ্চিম জার্মানীর পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী বাংলাদেশ সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক মীমাংসাসূত্রের জন্যেই তাগিদ দিয়েছেন। এটা ধরে নেওয়া যায়, তাঁরা কূটনৈতিক সূত্রে ইয়াহিয়া খানের রাজনৈতিক সমাধান সূত্রগুলিকে প্রত্যাখান করেছেন। কানাডা আর আয়ারল্যান্ডের আইন পরিষদের যেসব সদস্য বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ সফরে এসেছেন, তাদেরও একই কথা। তাঁরা স্বচক্ষে দেখে যাচ্ছেন, বাংলাদেশে ইয়াহিয়া খানের রাওয়ালপিণ্ডি চক্রের জল্লাদেরা একটা গোটা জাতিকে সাড়ে সাত কোটি নরনারী শিশুকে ধ্বংস করে দেওয়ার উদ্দেশ্য কি ধরনের হত্যাকাণ্ড করেছে। বাংলাদেশের প্রশ্নে রাজনৈতিক সমাধানের যে তাগিদ তাঁরা দিয়েছেন তাতে বুঝতে পারা যায়, ইয়াহিয়ার বাচনকে তাঁরা ঝাড়া অগ্রাহ্য করেছে। গোটা বাঙালী জাতিকে নিধন করার জন্য পাকিস্তানী শাসকচক্র যে ষড়যন্ত্র চালিয়ে এসেছে এতদিন, ইয়াহিয়ার বক্তব্য তারই একটা বেতালা পদক্ষেপের মহড়া ছাড়া যে আর কিছু নয় সে কথা আজ বিশ্বের মানুষ বুঝে নিয়েছে। পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন সমাজতন্ত্রী দেশ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে তাঁদের সমর্থন জানিয়ে আসছে। সর্বশেষ সংবাদে দেখা গেল, চেকোশ্লোভাকিয়ার কর্মকর্তারা সরকারীভাবে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছেন। তাঁরা বাংলাদেশের ব্যাপারে রাজনৈতিক মীমাংসার জন্যে তাগিদ দিয়েছেন। এর সোজা অর্থ এই যে, ইয়াহিয়া খানের রেডিও বাচনকে তাঁরা ধর্তব্যের মধ্যেই আনেননি। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। এটাই সত্য, এটাই বাস্তব, এটাই বর্তমান, এটাই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ নিজের শাসনতন্ত্র নিজেরাই তৈরী করবে। দুনিয়ার দেশ-দেশান্তরের কাছে এই ঘটনা অনিবার্য অপ্রতিরোধ্য ঘটনা হিসেবে উন্মোচিত হয়ে চলেছে। ইয়াহিয়া খানেরা মিথ্যা। স্বাধীন বাংলাদেশ সত্য। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি নরনারী-শিশু বুকের রক্ত ঢেলে এই সত্যের ভিত্তিতেই বাংলাদেশের মুক্তির দিনকে এগিয়ে নিয়ে আসছেন। ("জামিল শারাফি’ ছদ্মনামে রণেশ দাশগুপ্ত রচিত)