পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/১২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

97 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড ২০ জুলাই, ১৯৭১ ...পাকিস্তান সরকার শিক্ষিত সেনাবাহিনীর নিয়মিত মৃত্যু রোধ করতে আরও কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে? যেমন- রাজাকার বাহিনী তৈরী করেছে বিভিন্ন অঞ্চলে। আকাশ থেকে নিক্ষেপ করেছে রাশি রাশি প্রচারপত্র। তাতে বলা হয়েছেঃ হে দেশপ্রেমিক জনগণ দুষ্কৃতকারী ও অনুপ্রবেশকারীরা বড্ড খারাপ কাজ করছে। আপনারা তাদেরকে ধরিয়ে দিয়ে দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা দেখান। বাংলাদেশে ইয়াহিয়া খাঁ সাহেবদের জন্য এখনও দেশপ্রেমিক আছে, এ কথা ভাবলে হাসি পায়। তবে একটা কথা বলতেই হয়, বাংলাদেশের মানুষ দেশপ্রেমের বাস্তব পরাকাষ্ঠার প্রমাণ দিয়েছেন হাতে হাতে। একজন কৃষক ভাইয়ের সাথে আলাপ করছি। তিনি জমিতে রোয়া লাগাচ্ছিলেন। বললাম- কেমন আছেন? বললে-ভাল আছি, খুব ভাল আছি। বলেই মাথার টোপরের ভেতর থেকে একখানা কাগজ বের করে দিলে। বললে, এই এক্ষুণি ফেলেছে বিমান থেকে। ওখানেই বসে বসে পড়লাম। সেই প্রচারপত্র যাতে দেশপ্রেমিক জনগণের প্রতি আবেদন জানানো হয়েছে। কৃষক ভাইটি জানালেন, মুক্তিবাহিনীকে বলবেনতাদের জন্য আমরা ধান-চাল আটা-গম সব মজুদ করে রেখেছি। এমন জায়গায় রেখেছি, খান সেনাদের চোঁদপুরুষও খুঁজে পাবে না। অবাক লাগলো। একজন সাধারণ চাষী মুক্তিবাহিনীর জন্য সর্বস্ব পণ করেছেন। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার দসু্য সেনাবাহিনী যা করছে, তা সমস্ত অত্যাচারের ইতিহাসকে স্নান করে দিয়েছে। প্রতিটি কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী প্রতিদিন অনুভব করছেন, পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিবাদী ধনিকদের দালাল পাকিস্তানী হানাদার সেনার হাত থেকে মুক্ত করতেই হবে স্বদেশকে তাই দেশের সমস্ত অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করছেন। দেশের সাধারণ মানুষ। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে জনগণের আন্তরিক সহযোগিতাই মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের কারণ। রাজাকার বাহিনী কিংবা শান্তি কমিটি করেও কূল পাওয়া যাচ্ছে না। জনগণের ব্যাপক অংশে বিরাজ করছে অসন্তোষের তীব্র দাবদাহ।... আজ পাকিস্তান বলতে যা বোঝায়- তা হল পশ্চিম পাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কোনো অভিযোগ নেই। পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ আমাদের মতই শোষিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত। কিন্তু পাকিস্তানী শাসকচক্র পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষকে মিথ্যে ভাঁওতায় ভুলিয়ে, কাশ্মীরে নিয়ে যাওয়ার নাম করে বাঙালীকে হত্যা করবার কাজে লাগাতে চেয়েছে। সিন্ধু থেকে কৌশলে এভাবে স্বল্পমেয়াদী ট্রেনিংপ্রাপ্ত লোক আনা হয়েছে সীমান্ত অঞ্চল রক্ষার জন্যে মুক্তিবাহিনীর হাতে এরাও প্রচণ্ড মার খাচ্ছে। গোড়াতে সেই যে চাষী ভাইয়ের কথা বলেছিলাম। তিনিই বলছিলেন- একটা মজার ব্যাপার দেখেছেন? মজার ব্যাপার? আমি অবাক হলাম- চারিদিকে হত্যাকাণ্ড, লুটতরাজ এবং অত্যাচারের মধ্যে মজার ব্যাপারটা কি? তিনি বলছিলেন, সিন্ধু থেকে আনা একদল সেনা রাস্তার ধারে বসে নিজেদের ভাগ্য নিয়ে আলোচনা করছে। তারা এ হত্যাকাণ্ডে নিজেদের হাত রক্তাক্ত করতে চায় না। তাদের মধ্যে কেউ কেউ দেশে ফিরে যেতে চায়। আর কেউ বা বসে বসে কাঁদে। এরা যুদ্ধ করতে চায় না, মরতে চায় না। পাকিস্তানী শাসকচক্র সিন্ধুর শোষিত জনগণকে লেলিয়ে দিয়েছে শোষিত বাঙালীদের বিরুদ্ধে। মানুষ যুদ্ধ নয়- মানুষ ভাবে, মানুষ চিন্তা করে, মানুষেরই শুধু বিবেক রয়েছে। তাই সিন্ধী, বেলুচী এবং সীমান্ত প্রদেশের লোকেরা লড়তে চায় না। একজন কম্যাণ্ডিং অফিসার তার অধীনস্থ সেনাদেরকে বাঙালীদের বাড়ি ঘর লুট করতে বললে তারা রাজী হয়নি। উল্টো তারা কম্যাণ্ডিং অফিসারকেই হত্যা করে।... (অধ্যাপক আবদুল হফিজ রচিত)