পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/১২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

98 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড ২ নভেম্বর, ১৯৭১ বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা আজ শত্রমুক্ত। এইসব জায়গায় মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় গ্রামবাসী প্রতিটি গ্রমকে দুর্ভেদ্য দুর্গের মতো করে গড়ে তুলেছে। যে হাত কেবল লাঙল ধরতো, কিংবা কলম ধরতো, কিংবা যে হাতে একতারা শোভা পেতো-সেই হাত, সেই একই হাত আজ তুলে নিয়েছে রাইফেল। এই সব এলাকা কয়েকদিন আগে ঘোরার সময় খান সেনাদের অত্যাচারের চিহ্ন দেখেছি, শুনেছি তাদের বর্বরতার কথা, জেনেছি মুক্তিবাহিনী ও গ্রামবাসীর সম্মিলিত ক্রমাগত যুদ্ধের কথা, জয়ের কথা। তরুণ যোদ্ধাদের সঙ্গে ভাব-বিনিময় করেছি এবং বার বার অনুভব করেছি কি গভীর আমাদের দেশের মানুষের দেশপ্রেম; কি প্রচণ্ড সংগ্রামের, যুদ্ধের ইচ্ছা তাদের। এবং কি কঠিন পণ নিয়েছে তারা সবকিছু উৎসর্গ করে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার। এসব জায়গায় যে কদিন খান সেনারা ছিল, সে কদিন তারা গ্রামগুলোর ওপর দিয়ে অত্যাচারের ঝড় বইয়ে দিয়েছে। বহু মানুষের ঘর-বাড়ি জুলিয়েছে, ফসলের ক্ষতি করেছে, বাজার-দোকানপাট জুলিয়েছে, মানুষকে, অত্যাচার করেছে মেয়েদের উপর। এইসব অন্যায়-অত্যাচারের মধ্য দিয়ে মানুষ-পদদলিত, শোষিত মানুষ জেগে উঠেছে। তাদের চোখে এখন শত্রহননের আকাঙ্খা। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত প্রতিটি মানুষ এখন যুদ্ধ করে যেতে চায়। একজন গ্রামবাসী আমায় বললেনঃ যুদ্ধ তো সবে শুরু, এখনই কি জয়ের কথা বলেন। খান সেনাদের বিষদাঁত ভেঙে না দেয়া পর্যন্ত জয় কিসের। আমাদের হাতে অস্ত্র ছিলো না তাই খান সেনারা ফাঁকা মাঠে কারদানি দেখিয়েছে, এখন তো আমরা সবে অস্ত্র ধরেছি, তারা শোধ তুলবো না? গ্রামের একজন যুবক বললেন, ‘অস্ত্র যখন ধরেছি তখন বেঁচে থাকতে খান সেনারা এই গ্রামে আর ঢুকতে পারবে না। চেষ্টাও তারা কম করেনি, ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়েও চেষ্টা করেছে, কিন্তু এখন মজাটা টের পেয়েছে তারা। এখন তারা মাইল সাতেক দূরে থানা গেড়েছে।’ সবখানেই এক মানসিকতা। খরচাপাতি কমিয়ে দিয়েছে সবাই। খাদ্যসামগ্রী জমিয়ে রাখছে ভবিষ্যতের জন্য। গ্রামের এখানে-ওখানে জঙ্গল হয়ে গেছে- আমাদের যোদ্ধাদের জন্য খুবই অনুকূল। গ্রামবাংলা যুদ্ধ ও জীবন সব এখন একাকার হয়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধারা এমন চতুরতার সঙ্গে খানসেনাদের ঘায়েল করে চলেছে যে আমাদের কোন প্রাণহানি হয় না বল্লেই চলে। তার কারণ নিজেদের পরিচিত দেশে যুদ্ধ করে চলেছে মুক্তিসেনারা সহজে তারা দেশের মাটির সঙ্গে, মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। মানুষের শত্রুখান সেনারা তা পারে না। কাউকেই তারা বিশ্বাস করতে পারে না, দেশের মাটি ও পরিবেশ তাদের অনুকূল নয়। কারণ এদেশ তাদের নয়, এদেশকে তারা জানে না, এ দেশের মানুষকে চেনে না, জানে না। তারা কেউ এদেশের নয়। তারা যে জোর করে এদেশে থাকতে চাইছে সেটি নিতান্তই অস্বাভাবিক ব্যাপার তাই তারা এদেশে থাকতে পারবে না, এদেশ থেকে তাদের চলে যেতে হবে, এদেশের মানুষই তাদের তাড়িয়ে দেবে। মাটির সঙ্গে ও মানুষের সঙ্গে যারা শত্রতার করে তাদের এরকমই পরিণত হয়ে থাকে। যুদ্ধ কিভাবে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে তা দু-পাঁচজন মুক্তিসেনার সঙ্গে আলাপ করলেই জানা যায়। যারা আহত হয় তাদের কারুর হাতে বা পায়ে, কিংবা কাঁদে বা শরীরের অন্য কোথাও হয়তো গুলি লাগে। এগুলো যেন কাউকে বলার মতো কোন ব্যাপার নয়। নিতান্ত জিজ্ঞেস করলে উত্তর পাওয়া যায়ঃ গুলি তা লেগেছিল