পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/১২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

102 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড ১ ডিসেম্বর, ১৯৭১ যাদের চক্ষু আছে এবং চক্ষু থেকেও যাঁরা অন্ধ নন, আজ তাঁদেরকে একবার বাংলাদেশের রণাঙ্গনে দিকে দৃষ্টিপাত করতে অনুরোধ করবো। একবার চোখ খুলে দেখুন আমাদের সংগ্রামী বীর যোদ্ধা বাঙালী যুবকগণ কিভাবে পশ্চিম পাকের হানাদার পশুদের খতম করে ক্রমাগত জয়যাত্রার পথে এগিয়ে চলেছেন। বাংলাদেশের চূড়ান্ত দুর্দিনে পশু পাকসেনাদের হাত থেকে দেশকে সম্পূর্ণ মুক্ত করবার জন্য মুক্তিবাহিনীর বীর সৈনিকগণ আত্মত্যাগ, সাহসিকতা, বিক্রম, ধৈর্য এবং দেশপ্রেমিকতার যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, বিশ্বের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তার নিদর্শন একান্ত বিরল। একবার চেয়ে দেখুন যশোর রণাঙ্গনের দিকে-আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের আঘাত সামালাতে অপারগ হয়ে কিভাবে খানসেনারা পশ্চাদপসারণ করছে। খুলনায় একটি জাহাজ ডুবিয়ে আমাদের সেনারা জাহাজ চলাচলের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছেন। সিলেট, চাটগাঁ, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, কুষ্টিয়া সর্বত্রই আমাদের বীর যোদ্ধাদের অগ্রগতি এবং পাকসেনাদের পরাজয় অব্যাহত রয়েছে। ঢাকায় বেসামাল হয়ে সামরিকচক্র বারবার সান্ধ্য আইন জারি করে নিরীহ নিরস্ত্র নাগরিকদের হত্যা ও নির্যাতন করছে। কিন্তু তাই বলে বাঙালীর মনোবল হ্রাস পায়নি। আমাদের বীর সেনাদের অগ্রগতির দেখুন এবং জেনে রাখুন, ইনশাল্লাহ সময় আর খুব দূরে নাই যখন ঢাকায় স্বাধীন বাংলার পতাকা গৌরবের সঙ্গেই উত্তোলিত হবে। সে কারণেই বলছিলাম যাঁদের চক্ষু থেকেও যাঁরা অন্ধ নন আজ তাঁরা চোখ খুলে একবার দেখুনশ্রবণশক্তি যদি বধির না হয়ে থাকে তবে স্বাধীন বাংলার বেতার কেন্দ্রের এই বিজয় বার্তাগুলো শুনুন। কথাগুলো এইজন্য বলছি যে বাংলাদেশ এখনো কিছুসংখ্যক বাঙালী আছেন যারা চোখ থেকেও অন্ধ এবং শ্রবণশক্তি থেকেও বধির। ঢাকা, রাজশাহী প্রভৃতি বেতার কেন্দ্রে এই জাতীয় কিছু অন্ধও বধির বাঙালী এখনো পশ্চিম পাকিস্তানের প্রভুদের মনোরঞ্জনের জন্য দেদার চীৎকার করে যাচ্ছেন। এইসব বাতুলদের তখনই জ্ঞানোদয় হবে যখন মুক্তিবাহিনীর সঙ্গীন তাদের গর্দানকে স্পর্শ করবে। যে প্রভুদের মনোরঞ্জনের জন্য এখনো কিছুসংখ্যক জন্মদালাল বাঙালী গলদঘর্ম হচ্ছেন তাদের বোঝা উচিত যে আজ ঐসব প্রভুদের কি অবস্থা। পশ্চিম পাকিস্তানেও বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জুলে উঠছে। বেলুচিস্তানে বেলুচরা এবং সীমান্ত প্রদেশে পাঠানরা এবার অস্ত্ৰধারণ করেছে। এমান কী রাজনীতির ক্ষেত্রে বালকোচিতে চাপল্যই যাঁর বৈশিষ্ট্য সেই জুলফিকার আলী ভূট্টোর খোদ জন্মভূমি সিন্ধু ও আজ বিক্ষুদ্ধ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ভূট্টো এবং ইয়াহিয়া চক্রের পালাবার স্থানটি পর্যন্ত থাকবে না। এই দুই জানোয়ারের শেষের সেই ভয়ঙ্কর দিনটির কথাই আমরা এখন ভাবছি। জানি, বহু দুঃখ এবং বেদনা, এবং নিপীড়ন বহু রক্তক্ষয় এবং মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের দিন কেটেছে এবং এখনো অনেক ক্ষেত্রে সেভাবেই তাঁদের দিন কাটাতে হচ্ছে। জানি, আমরা যারা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে দুদিন পর বিজয়ীর বেশে নতুন করে যাত্রা শুরু করবো, তাদের অনেকেই প্রিয়জন হারানোর গভীর বেদনাকে কোনদিন ভুলতে পারবো না। যে জীবন আমরা হারিয়েছি, যে সম্মান এবং ইজ্জত আমরা পশুদের হাতে বিসর্জন দিয়েছি, যে সম্পদ আমাদের লুষ্ঠিত হয়েছে, জানি, সেসব আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এই অবক্ষয়, এই অপরিসীম ত্যাগের মধ্য দিয়ে আমরা একটি জাতিকে, একটি দেশকে বিশ্বের ইতিহাসে নবজন্ম দান করতে চলেছি- এই মহান গৌরব একান্তভাবেই আমাদের বাংলাদেশের বর্তমান বংশধরদের। আমাদের পূর্বপুরুষদের এই গৌরব অর্জনের সৌভাগ্য হয়নি। সেদিকে থেকে আমরা অনেক ভাগ্যবান। দুঃখ আমাদের অনেক হয়েছে, রক্ত এবং জীবন আমাদের প্রচুর দিতে হয়েছে সত্য কিন্তু স্বাধীনতার জন্য এই মৃত্যু এই রক্তদান, এই আত্মত্যাগ সবকিছুর মধ্যেই একটি বিরাট মাহাত্ম্য আছে। সেই মাহাত্ম্যই আমাদের মহীয়ান করে তুলেছে। তার জোরেই ভবিষ্যৎ বংশধরগণ আমাদের ললাটে গৌরবের টিকা দিয়ে বলতে পারবে যে আমরা আজ দেশের কারণে মরতে শিখেছিলাম বলেই তারা মানুষের মত বাঁচতে পারবে। আমদের