পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/১২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

104 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড সংবাদ পর্যালোচনাঞ্চ ২১ জুলাই, ১৯৭১ একটি ছোট্ট খবর। পাকিস্তানী জঙ্গীশাহী শীগগীরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বিচার করবে। কখন, কোথায়, বিভাবে এ বিচার প্রহসন জমে উঠবে, খবরে তার বিস্তারিত বিবরণের উল্লেখ নেই। তবে প্রকাশিত খবরে এটুকু স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে যে, ইয়াহিয়া খানের জঙ্গী সরকার স্বাধীন বাংলার জনক শেখ মুজিবের বিচারের আয়োজন করছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ-রাষ্ট্রদ্রোহিতা। ভ্রান্তি বিলাসের কি বিচিত্র পুনরাবৃত্তি! সত্যকে, ন্যায়কে, বিবেককে, টুটি টিপে হত্যা করে ক্ষমতার গদি আঁকড়ে থাকবার কি দুঃসাহসিক প্রয়াস! কি সীমাহীন স্পর্ধা! এ তো নতুন কিছু নয়। বিচার নামে প্রহসনের জালিয়াতি মঞ্চ সাজিয়ে শেখ মুজিবের কণ্ঠকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেবার এমনি এক স্পর্ধিত অপচেষ্টা ছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। উনিষ শ ছিষট্টি সালে বীরপ্রসবিনী বাংলার অগ্নিসন্তান শেখ মুজিব যেদিন ছয়দফা দাবী পেশ করেন, সেদিনই ত্রাসে আতঙ্কে থরথর করে কেপে উঠেছিলো পশ্চিমা শাসককুলের তখতে তাউস। আর তাই সেদিনের গণবিরোধী শাসক সামরিক জান্তার মুখপাত্র প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল গৃহযুদ্ধ ও অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগের হুমকি। উদ্ধত রাজরোষ জেল-জুলুম আর বক্ষভেদী বুলেট হয়ে নেমে এসেছিল আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীদের উপর-স্বাধীনচেতা বাঙালী জাতির উপর। কিন্তু তাতেও যখন ফল হয়নি, যখন বাংলার গণশক্তির ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মুখে আয়ুবের রণহঙ্কার বিধবার অসহায় আর্তনাদের মত বাতাসে মিলিয়ে গেছে, আইয়ুবশাহী শেষরক্ষার জন্য সাজিয়েছিল মিথ্যা আগরতলা ষড়যন্ত্রের মামলা। উদ্দেশ্য ছিল, ভাড়াটিয়া জজ, উকিল আর সাক্ষীসাবুদের সযত্নসৃষ্ট ষড়যন্ত্রের জালে বেঁধে শেখ মুজিবকে চিরতরে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়া। কুর্মিটােলা সেনানিবাস দিনের পর দিন সেই সাজানো-গুছানো মামলার বিচার প্রহসন চলেছে। ভাড়াটিয়া সাক্ষীদের মিথ্যা জবানীর রেকর্ডপত্র স্তুপীকৃত হয়ে উঠেছে-গোটা সরকার তার সর্বশক্তি দিয়ে শেখ সাহেবকে আটকাবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সকলি ব্যর্থতার পর্যবসিত হয়েছে। বাংলার মানুষ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে মনে করেছে তাদের নিজেদেরেই বিরুদ্ধে, সমগ্র বাংলার বিরুদ্ধে এক সুগভীর ষড়যন্ত্র। আর তাই সর্বশক্তি নিয়ে তারা রুখে দাঁড়িয়েছে এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে, আইয়ুবশাহীর বিরুদ্ধে। শেখ মুজিবের পিছনে কাতারবন্দী বাংলার মানুষের সেই প্রতিরোধ আন্দোলনের স্রোতের মুখে খুলে গেছে জেলের তালা, খড়কুটোর মত ভেসে গেছে ক্ষমতাদপী শাসকের মসনদ আর আইয়ুব-মোনেম নিক্ষিপ্ত তারপর বহুদিন গত হয়েছে। বাঙালীর আশা-আকাঙ্খার বিশ্বস্ততম প্রতিনিধি, বঞ্চিত বাংলার বিবেকের কণ্ঠস্বর শেখ মুজিবর রহমান জেল-জুলুম আর ত্যাগ-তিতিক্ষার দুঃসহ আগুনে পুড়ে হয়েছেন আরও খাঁটি সোনা হয়েছেন বঙ্গবন্ধু-বাংলার মুকুটহীন সম্রাট। বিগত সাধারণ নির্বাচনে নিঃশব্দ ব্যালটের বিপ্লবে বাংলার মানুষ সমগ্র পৃথিবীকে দেখিয়ে দিয়েছে-শেখ মুজিব বাংলার, বাংলা শেখ মুজিবের। তারা আরও দেখিয়ে দিয়েছে-শেখ মুজিব শুধু বাংলার নন, সারা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু দলের নেতা। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ বিশ্ববাসীকে বিস্মিত হতবাক করে দিয়ে অসহযোগ আন্দোলনের ইতিহাসে এক নয়া রের্কড সৃষ্টি করেছে। সবচাইতে বড় কথা, শেখ মুজিবেরই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে বাঙালী জাতি প্রতিষ্ঠা করেছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। তারই নির্দেশে বাংলার মানুষ হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। ইয়াহিয়ার জল্লাদ বহিনী গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে, লক্ষ লক্ষ মানুষকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করেছে। এই নরপশুর দল ছারখার করে দিয়েছে অগণিত সোনার সংসার-চিরতরে নিভিয়ে দিয়েছে লক্ষ লক্ষ ঘরের প্রদীপ। কিন্তু বুলেট শুধু রক্তই ঝরাতে পারে-মানুষের হৃদয়ের অমোঘ বাণীকে, তার আত্মার আন্তরিক আকাংক্ষাকে পিষে মারতে পারে না। ওরাও পারেনি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনে যে অনিবার্য প্রদীপশেখা শেখ মুজিব জেলেছেন সাড়ে সাত কোটি

  • সংবাদ পর্যালোচনা’ শীর্ষক ধারাবাহিক কথিকাগুলি আমির হোসেন রচিত।