পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/১২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

105 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড বাঙালীর অন্তরে, হানাদার সেনা-দসু্যদের হিংস্র থাবা তা নিবিয়ে দিতে পারেনি। আর পারেনি বলেই তা আজ বাংলার দশদিগন্তে চলেছে শত্রহননের মহোৎসব। দিন যায়, রাত যায়, আর স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে ওঠে জল্লাদবাহিনীর মৃত্যুঘন্টার শব্দ। ওরা দেখতে পাচ্ছে ওদের পরাজয় আসন্ন। ওরা বুঝতে পারছে সোনার বাংলার বুকটিকে চিরে চিরে খাবার দিন শেষ-এবার বিদায়ের পালা। তাই মুমূর্য শয়তানের মরণার্তির মতই ইয়াহিয়ার মুখে অশ্রাব্য প্ৰলাপধ্বনি। তাই আইয়ুবের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শোচনীয় পরিণতির স্মৃতি মিলিয়ে যাবার আগেই তার জারজ সন্তান আজ ব্যতিব্যস্ত শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে নতুন মামলা সাজাবার আয়োজনে। কিন্তু কিসের মামলা? কিসের বিচার? কে করবে কার বিচার? নরঘাতক ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনেছে। কিন্তু ক্ষমতাদপী সেই উন্মাদ জেনারেল রঙীন পানীয়ের নেশায় বুদ হয়ে আজ এই সত্যটুকু উপলব্ধি করবার মানসিকতা হারিয়ে ফেলেছে যে, শেখ মুজিব আজ আর ইয়াহিয়ার শক্তির উৎস বন্দুকের নল। আর সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর স্বাধীন আবাসভূমি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের শক্তির উৎস তার দেশবাসীর শুভেচ্ছা, সমর্থন ও সংগ্রামী চেতনা... ২৮ জুলাই, ১৯৭১ একটি বিদেশী বার্তা প্রতিষ্ঠানের খবরে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় অফিসআদালতে ও দোকান-পাটের নামফলক বাংলার পরিবর্তে ইংরেজী ও উর্দুতে লেখার নির্দেশ জারি করা হয়েছে। খবরে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, যেসব স্থান বা প্রতিষ্ঠানের নামের সংগে অমুসলিম গন্ধ রয়েছে সেগুলো পাল্টিয়ে নয়া নামকরণের অভিযান শুরু হয়েছে। খবরটিতে নতুনত্ব না থাকলেও কৌতুকের খোরাক আছে। কারণ, ইতিহাসের চাকা আর ঘড়ির কাঁটা পেছনদিকে ঘোরে না জেনেও কসাই ইয়াহিয়া ইতিহাসের চাকা আর ঘড়ির কাটাকে পশ্চাদমুখী করার হাস্যকর প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। বাংলার পরিবর্তে উর্দু এবং ইংরেজীতে নামফলক লেখা আর বিশেষ বিশেষ স্থাপন ও প্রতিষ্ঠানের নয়া মুসলমানী নামকরণের নির্দেশে ওদের দুরভিসন্ধিটাই নগ্নভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। আমরা এতে বিস্মিত হইনি। বিক্ষুব্ধ হলেও আমরা এতে মোটেই বিচলিত হইনি। করণ, ওদের এই অপচেষ্টা নতুন কিছু নয়। চব্বিশ বছর আগে যেদিন বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা এদেশ ছেড়ে যায় সেদিনই পশ্চিম পাকিস্তানী উপনিবেশবাদীচক্র মেতে ওঠে বাংলার বিরুদ্ধে সুগভীর ষড়যন্ত্রে। এই ষড়যন্ত্রের লক্ষ্য ছিল বাঙালী জাতিকে চিরদিন পায়ের নীচে দাবিয়ে রাখা। আর এই ঔপনিবেশিক লক্ষ্য হাছিলের স্বার্থে পশ্চিমা শাসককুল বাঙালীর রাজনৈতিক অধিকার, অর্থনৈতিক হিস্যা, তাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি আর স্বকীয় সত্তার ওপর হামলা করেছে বার বার। বাঙ্গালীদের নিজস্ব পরিচয়, তাদের স্বতন্ত্র সত্তাকে চিরতরে মুছে ফেলবার জন্য চক্রান্ত চলেছে সুপরিকল্পিতভাবে চেষ্টা চলেছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাহিত্য ও সংস্কৃতিক দিক দিয়ে তাদের পঙ্গু করে রাখবার... বাংলার মানুষের সাহিত্য সংস্কৃতিকে পঙ্গু করার যে নির্লজ্জ প্রচেষ্টা চলে এসেছে চব্বিশ বছর ধরে, পরাধীন বাংলার শেষ সুবেদার মোনেম খানের আমলের একটি ঘটনায় তার একটি সুন্দর চিত্র পাওয়া যাবে। দুরন্ত প্রতাপশালী গভর্নর মোনেম খান একদিন লাটভবনের দরবার কক্ষে ডেকে পাঠালেন ঢাকার কবি, সাহিত্যক, লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের। এ এত্তেলা পেয়ে হাজির হলেন সকলে। তাদের মধ্যে ছিলেন ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লা, অধ্যক্ষ মুহম্মদ আবদুল হাই, আবুল হাশিম, কবি জসীমুদ্দীন এবং অন্যান্য। হুকুম করলেন গভর্নরঃ কি লেখাপড়া করেছেন আপনারা? রবীন্দ্রসঙ্গীত লিখতে পারেন না? জবাব দিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৎকালীন অধ্যক্ষ মুহম্মদ আবদুল হাই। বললেনঃ “না, পারি না। আমরা কি করে রবীন্দ্রসঙ্গীত