পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/১৩৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

| 10 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড ভেবেছিল বিচারের নামে প্রহসনের মঞ্চ সাজিয়ে মিলিটারী জজ-ব্যারিস্টারের পুতুল নৃত্যের ব্যবসা করে শেখ মুজিবকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া যাবে-আর তার ফলে মনোবল ভেঙ্গে যাবে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের। তার ভাড়াটিয়া ডালকুত্তা বাহিনীর দুরু দুরু বক্ষে আসবে নতুন শক্তি-দাবিয়ে দেওয়া যাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ। কিন্তু এখানেও হতাশ হয়েছে জোনারেল ইয়াহিয়া। এ খবরে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে মুক্তিবাহিনী-তীব্রতর হয়েছে তাদের আক্রমণধারা। তারই পাশাপাশি বিশ্বজনমতের প্রচণ্ড চাপে শাণিত ছুরিকা খসে পড়েছে জল্লাদের হতে থেকে। তার প্রমাণ- বিচারের সঙ্গে সঙ্গেই শেখ মুজিবকে গুলি করা হবে না বলে জাতিসংঘে পশ্চিম পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত আগা হিলালীর ঘোষণা। ইয়াহিয়ার সামনে এখন পাকিস্তান নামক মৃত ঘোড়াটিকে জীবিত করে তোলার আর কোন পথই খোলা নেই। তবু শেষ চেষ্টা করছে সে। শেখ মুজিবকে ফিরিয়ে দিয়ে হলেও যদি বাংলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে রাখা যায়, সেটাই তার শেষ চেষ্টা। হতে পারে, এই উদ্দেশ্যেই চলেছে তেহরানের গোপন কূটনৈতিক তৎপরতা। আবার এমনও হতে পারে যে, এই তৎপরতা নতুন কোন জালিয়াতি, কোন দুরভিসন্ধি হাসিলের জঘন্য ষড়যন্ত্রেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।... ২৬ আগষ্ট, ১৯৭১ একটা খবরের মত খবর করাচী থেকে এ-এফ-পি জানিয়েছে যে, পাকিস্তানী জঙ্গীশাহী বাংলাদেশের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের প্রতি জনগণের প্রতিনিধি হিসাবে দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসার আবেদন জানিয়েছেন। যেসব সদস্য জল্লাদশাহীর দৃষ্টিতে নিরপরাধ সুবোধ বালক, তাদের প্রতিই এই আবেদন জানানো হয়েছে। রেডিও পাকিস্তানের মারফত সরকারী মহল গণপ্রতিনিধিদের সর্বপ্রকার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। খবর শুনে হাসবো না কাঁদবো ভেবে পাই না। মনে হয়, পৃথিবীর সবকিছুই সীমা আছে- সীমা নাই শুধু বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে ওদের নির্মম পেশাদারী রসিকতার। সম্ভবতঃ সে কারণেই, এতদিন পরে জঙ্গীশাহী গণপ্রতিনিধিদের প্রতি স্বীয় দায়িত্ব পালনের আবেদন জানাতে এতটুকু লজ্জাবোধ করেনি। কে না জানে, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে এই দেশবাসীর প্রতি দায়িত্ব পালনের জন্যই তারা বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন। আর এজন্যই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে বাংলার মানুষ নিঃশব্দ ব্যালটের বিপ্লবের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের শিরদেশে পরিয়ে দিয়েছিল ইতিহাসের নজিরবিহীন নির্বাচনী বিজয়ের গৌরবময় শিরোপা। বাংলার মানুষ বিগত নির্বাচনে শেখ মুজিব এবং তার অনুসারীদের শুধু ভোট দেয় নাই- দিয়েছল হৃদয়ের অন্তহীন ঐশ্বর্যমণ্ডিত অবিচল বিশ্বাস, ভালোবাসা আর আস্থা। এ বিশ্বাস ও আস্থার যাতে এতটুকু অমর্যাদা না হয়, স্বীয় দায়িত্ব পালনে যাতে বিন্দুমাত্র অবহেলা না হয়, সেই সচেতন সতর্কতাই গণপ্রতিনিধিদের সমাবেশ ঘটিয়েছিল ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে। দিনটা ছিল ৩রা জানুয়ারী ১৯৭১ সাল। বাংলার উদার আকাশের নীচে শীতাত দিনের শেষ প্রহরে স্নিগ্ধ সূর্যালোক-স্নাত সুবিশাল রেসকোর্সের জনারণ্য আর উপরে জাগ্রত বিধতাকে সাক্ষী রেখে সেদিন বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিরা শপথ নিয়েছিলেন। এক হাত বুকের উপর রেখে আরেক হাত উর্ধ্বে তুলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে গণপ্রতিনিধিরা বিবেকের নামেই ওয়াদা করেছিলেন : ‘জীবনের বিনিময়ে হলেও আমরা আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব। এই শপথ যে ধোঁকাবাজির ভড়ং ছিল না, ছিল তাদের ঈমানেরই অঙ্গ-সেই সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর ভাষণেও তার সুস্পষ্ট আভাস ছিল। শেখ মুজিব সেদিন বাংলার মানুষকে দ্ব্যর্থহীন ভায়ায় নির্দেষ দিয়েছিলেন ; যদি কেউ এই শপথ ভঙ্গ করে, যদি কোন গণপ্রতিনিধি তোমাদের বিশ্বাস ও আস্থার অমর্যাদা করে, দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয-তাকে জ্যান্ত কবর দিও। এমনকি এই যদি আমি করি-আমাকেও তোমার রেহাই দিও না।