পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/১৪৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

125 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড আপনি সেদিন রুটিখানা না দিলে কি যে হত? উপোস করার অভ্যেস অবশ্য আছে। কিন্তু যুদ্ধের জন্যে যে তাকদ দরকার ঐ রুটিখানাই তা আমাকে দিয়েছিল। আপনি ওটা না দিলে কর্মটি বাধা দিয়ে বললেন-সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোককে স্মরণ করুন ঐ এক টুকরো রুটি যে সময় বিশেষে এত মূল্যবান হয়ে উঠবে, তাতো আমি জানতাম না। বৃদ্ধ ভদ্রলোকে বোধকরি জানতেন। দুজনেই মাটির দিকে তাকালেন। দুজনের অভিভূত মনে একজন বৃদ্ধের মুখচ্ছবি। একজনের মনে বাস্তব, আর একজনা তাঁকে দেখেননি বলে ছবিটি কাল্পনিক। কিন্তু আর একটা ছবি ওদের সামনে স্পষ্ট। দুজনের চোখের সামনেই অতি সাধারণ এক টুকরো রুটি। ২৭ জুন, ১৯৭১ স্বাতীর যুদ্ধ স্বাতী। বয়েস সাড়ে পাঁচ। পেশা-ঘরকান্নার কাজে মাকে টুকিটাকি সাহায্য করা, আৰু বাড়ী ফিরলে দরজা খুলে দেয়া, ছোট বোনটিকে যাবতীয় পার্থিব বিষয়ে উপদেশ দান। ইস্কুলের পড়াশুনা এখনও ওর শুরু হয়নি, বাসায় প্রথম পাঠের অনেক দূর এগিয়ে গ্যাছে। বাংলাদেশের হাজার মেয়ের মত সাড়ে পাঁচ বছরের ছোট্ট স্বাতী এখন যুদ্ধ করছে। ওর বাবা ছিলেন অধ্যাপক। আর অধ্যাপক মানেই জল্লাদ ইয়াহিয়া বাহিনীর পয়লা নম্বরের শক্র। ওদের চোখে শিক্ষা ও শিক্ষকতা মারাত্মক অপরাধ। মনুষের বুদ্ধি, মেধা প্রভৃতি আণবিক বিস্ফোরকের চাইতেও মারাত্মক; ফলে কুচক্রী পাশব শক্তির ষড়যন্ত্রে ওদের ছোট্ট সংসারেও নাড়া পড়ল। সংসারের সাজানো বাগান পেছনে ফেলে ওদের এগিয়ে যেতে হলো অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। প্রথম বাড়ি থেকে বেরিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল একটি স্কুলের ছাত্রাবাসে। দিন দশেকের মধ্যে ওখন থেকে সরে যেতে হলো গ্রামের আরো অভ্যন্তরে, তারপর আরও ভেতরে যেখানে আদি অকৃত্রিম পা ছাড়া বিংশ শতাব্দীর কোন যানবাহন চলে না। চিরকালের পরিবেশ ত্যাগ করে সম্পূর্ণ নতুন করে নতুন এক পরিবেশে এসে দাঁড়াল অব্দি চলে। এখন ঐ টাকায় অনির্দিষ্টকালে চালাতে হবে। প্রথম দিকে আলুভর্তা, ডাল আর দুবেলা ভাত বরাদ্দ রইল, কিন্তু ওতে মুখ ঘুরিয়ে রইল স্বাতী। বল্লো, আমি নাশতা খাবো। আমার বড়ো খিদে লাগে। ওর মা এসে মাথায় বুলালেন, নাশতা এখন কোথায় পাব মামণি? এখন তো যুদ্ধ চলছে। সাবইকে তাই কষ্ট করতে হচ্ছে। আমরা যুদ্ধ করেছি? স্বাতীর মুখের রেখা পালটে গ্যালো সহসা ওর চোখে-মুখে ঔজ্জ্বলতার ছোঁয়া লাগল। কণ্ঠ নামিয়ে বল্লো, ভূট্টো খুব পাঁজী, খুব শয়তান। আর শেখ মুজিব কতো ভাল, না আম্মু? আম্মু মাথা নাড়লেন। এরপর স্বাতীই সংসারের সব সমস্যার সমাধান করে ফেলল। ওর আবুর পরনের একমাত্র লুঙ্গিটা ছিড়ে এসেছিল কিন্তু কেনা হচ্ছিল না। স্বাতীর মাও কবার বলেছেন আর একটা কিনে ফেলতে। কিন্তু পয়সার অভাব তখনকার জন্যে নিদারুণ সত্য। স্বাতী বল্লো, যুদ্ধ থামলে তোমাকে একটা ভালো লুঙ্গি কিনে দেব আৰু এ কথার পর যথাশীঘ্ৰ লুঙ্গি কেনার ব্যাপারে ওর মায়ের চাপ কার্যকরী হলো না। ওর বাবা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।