পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/১৫০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড স্বাতীর ছোট বোনটির অনেকগুলো হবি। তার মধ্যে অন্যতম কান্না। কিছু একটা হাতের মুঠোয় পায়নি বলে হঠাৎ সেদিন কান্নায় প্লাবন বইয়ে দিল। বোনের রকম-সকম দেখে স্বাতী ভারি খাপ্পা। বোনকে রীতিমতো শাসাল সে, কতবার বলছি এখন যুদ্ধ হচ্ছে। খবরদার তুমি কান্নাকাটি করবে না। কাঁদলে মিলিটারি বুঝে ফেলবে আমরা এখানে আছি। আব্দুকে তখন ধরে নিয়ে যাবে। তারপর আব্দুর কানের কাছে মুখ লাগিয়ে বল্লো! আৰু! তুমি যে প্রফেসর তা কিন্তু কাউকে বলো না। তুমি যদি কিছু না বল, তাহলে তোমাকে কেউ চিনতেই পারবে না, আবার যুদ্ধ করে আমাদের জয় হলে তখন তুমি প্রফেসর বলবে। ওদের বাসস্থানের তিন-চার মাইলের মধ্যেই গোলাগুলির শব্দ শোনা যেত। ততদিনে স্বাতী চিনে ফেলেছে কোনটি মেশিনগানের শব্দ আর কোনটা শেল। বেশী আর অনেকক্ষণ ধরে শব্দ হলে বুঝত পাকিস্তানীদের আওয়াজ, অন্যদিকে পাশাপাশি কম শব্দ হলেই বুঝতে পারতো বাঙালীদের গোলাগুলির শব্দ সাড়ে পাঁচ বছরের স্বাতী যুদ্ধের অনেক কথাই শিখে ফেলেছিল। এইটা মেশিনগানের শব্দ, না আৰু? দূরের শব্দ শুনে স্বাতী বলতো। কখনো ছোট বোনকে ধমকে দিয়ে বলতো, তুমি কিছু বোঝ না। খালি বিস্কুট খেতে চাও। যুদ্ধের সময় কি বিস্কুট পাওয়া যায়। কান্নাকাটি থামিয়ে ছোট বোনটি তখন ফ্যালফ্যাল করে তাকাত ওর দিকে। আম্মু ও আৰু দুজনেই তাকাতেন। তখন ভবিষ্যতের অনেক পরিকল্পনার মুখর হতো স্বাতী ; আমাকে আর ছোট বোনকে দুটো শাড়ি কিনে দিয়ো যুদ্ধ থামলে। আমরা না একদিন পোলাও খাব তখন তখন তো তুমি আবার মাইনে পাবে। নিয়ে গ্যাছে? তোমার বইগুলো ওরা নষ্ট করেছে? এসব কথা শুনে ওর আকবুকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে হতো, ছল ছল করতো ওর মায়ের চোখ। আশ্চর্য, এসব মোটেই বিষাদ-বেদনা জড়াতো না ওর কণ্ঠে। স্বাভাবিক সহজভাবে বলতো সব কথা। যুদ্ধক্ষেত্রের একজন সৈনিক যেমন জীবনের সকল অস্বাভাবিকতা দূর করে পৃথিবীর নির্মমতম সত্যটিকে হাতের মুঠোয় রাইফেল তুলে দাঁড়ায়, তেমনি ওদের ছোট্ট সংসারে বাস্তবের কঠিন সত্যতার মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য প্রেরণা যোগাত সে। একদিন বিকেলে দিঘীর পাড়ে আৰুর সাথে বসে ছিল স্বাতী। চুপচাপ বসে মেশিনগানের শব্দ শুনছিল। হঠাৎ প্রশ্ন করল সে , আৰু যুদ্ধ কেন হয়? এ প্রশ্নের উত্তর ওর আব্দুর অজানা-কি উত্তর হতে পারে এই অবোধ সরল শিশুর ক্ষুদ্র প্রশ্নটির? মানুষ মারার কারিগর ইয়াখান! আপনি কি পারবেন এ প্রশ্নের জবাব দিতে? বাংলাদেশের মানুষের উপর কেন যুদ্ধ চাপিয়ে দিলেন আপনি? কি স্বার্থ রক্ষা করলেন নিরীহ লক্ষ লক্ষ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাকে নির্বিচারে হত্যা করে? আপনি তো পাকিস্তানের অখণ্ডতা চেয়েছিলেন; সেনাবাহিনীর পশুতু লেলিয়ে রাষ্ট্রীয় সংহতিকে নিহত করল কে? ইতিহাসের পাতায় একদিন পাকিস্তানের প্রথম শত্রু ইয়াহিয়ার কলঙ্কিত নামে সিন্ধু-বেলুচিস্তানের মানুষও থুতু ছিটাবে। আর বাংলাদেশের মানুষের কাছে প্রবাদে রূপ লাভ করবে এই কথাটির : বিশ্বাসঘাতকতার অন্য নাম ইয়াহিয়া খান। কিন্তু স্বাতীর কথায় আসি। দিঘীর কালো জলের দর্পণে মুখ রেখে স্বাতী বলেছিল ; আমাদের পেলেন থাকলে বেশ হতো। পেলেন দিয়ে কি হবে? অন্যমনস্ক আৰু প্রশ্ন করেছিলেন।