পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/১৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
130

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

প্রতিনিধি কণ্ঠ[]

১৯শে জুলাই, ১৯৭১

...টিক্কা-হামিদ, ভুট্টো-মওদুদী চক্র পূর্পরিকল্পনা অনুযায়ী সেনাপতি ইয়াহিয়া বলিলেন, “আলোচনার প্রয়োজন নাই, আলোচনা দ্বারা বাঙালীকে ঠাণ্ড করা যাইবে না। সেনাবাহিনী প্রস্তুত, হুকুম পাইলেই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বাঙালী জাতিটাকে চিরদিনের জন্য হুকুমের গোলাম বানাইয়া দিতে পারি।” হুকুম মিলিয়া গেল। রাতের অন্ধকারে পরিকল্পনা মোতাবেক আধুনিক অস্ত্র সজ্জিত হইয়া ইয়াহিয়ার জল্লাদবাহিনী নারী শিশু জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ১০ লক্ষ বাঙালীকে খুন করিল। নগর, বন্দর, গ্রাম, জনপদ, স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ, মন্দির, কারখানা, পত্রিকা অফিস সবই এই কসাইরা অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের মাধ্যমে ধ্বংস করিতে লাগিল। ইহারা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করিল। বাঙালী জাতি এই দানবীয় হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে জল্লাদদের হাত হইতে অস্ত্র কাড়িয়া লইয়া রুখিয়া দাড়াইল। বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করিল। কসাইদের অত্যাচার ও লুণ্ঠনের কারণে ৬০ লক্ষ বাঙালী হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-পৃষ্টান প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করিতে বাধ্য হইল। হানাদার বাহিনী খতম হইয়াছে, তাহা হইলে অত্যুক্তি হইবে না। আমরা যাহারা অসীম সাহসী মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত আছি তাহারা দেখিয়াছি বাংলার সংগ্রামী জনতা ও মুক্তিবাহিনীর নাম শুনলে কিভাবে এই হানাদার বাহিনী প্রাণ লইয়া দৌড়ায়। মার খাইতে খাইতে ইহারা এখন মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে আসিতে নারাজ। অপরপক্ষে এই পশুবাহিনী নিরীহ গ্রামবাসীর উপর অত্যাচার চালাইয়া প্রতিশোধ লইতে চাহিতেছে। এই প্রসঙ্গে দুই-একটি জেলার যুদ্ধ প্রসঙ্গ উল্লেখ করিতে চাই। তাহা হইতে বিশ্ববাসী বুঝিতে পারবেন প্রকৃত অবস্থা কি। একমাত্র নোয়াখালী জেলার শুভপুর, ছাগলনাইয়া, বান্ধুয়া, মুন্সিরহাট, পরশুরাম, রথি ইত্যাদি স্থানের সম্মুখযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর তিন হাজারের উপর সৈন্য নিহত হইয়াছে। গেরিলাদের আক্রমণে এই জিলার পেনাঘাটা, চন্দ্রগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর, মাদাসত্রীজের নিকট, বগাদিয়া, আলোরপাড়া, কাঠালিয়া, পারপাড়া, পাঠাননগড় ইত্যাদি স্থানে কর্নেল, মেজর, ক্যাপ্টেন, জে-সি-ও ইত্যাদি অফিসার সহ এক হাজারের উপর হানাদার বাহিনী নিহত হইয়াছে। আহতের সংখ্যা নিহতের সংখ্যার দ্বিগুণ হইবে। পার্শ্ববর্তী কুমিল্লা জিলার শত্রর অবস্থা আরও শোচনীয়। কুমিল্লা হইতে ফেনী পর্যন্ত হাইওয়ে রাস্তার দুই পার্শ্বে মিয়ার বাজার, চৌদ্দগ্রাম, জগন্নাথ দিঘী এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া, শালদা নদী, কসবা, আখাউড়া, গঙ্গাসাগর ইত্যাদি রণাঙ্গন হানাদার বাহিনীর গোরস্থানে পরিণত হইয়াছে। মুক্তিবাহিনীর সাথে গ্রমবাসী একত্র হইয়া যোগাযোগ ব্যবস্থা বানচাল করিয়া দিয়াছে। গেরিলা যুদ্ধ সম্বন্ধে নোয়াখালীর এক গ্রামবাসীর মন্তব্য এখানে উল্লেখ করিতে চাই। তাহারা পিতা-পুত্র দুইজনে শক্র যাতায়াতের রাস্তার পার্শ্বের জমিতে ইরি ধান কাটিতেছিল। এমন সময় মাইন বিস্ফোরণ ঘটিয়া শত্রর সৈন্যসহ দুইখানা ট্রাক ধ্বংস হইয়া যায়। পরের দিন গ্রামবাসীরা তাদের নিকট ঘটনার বিষয় জানিতে জড়ো হয়। তখন বৃদ্ধ বলিতে থাকনে, “যুদ্ধের কথা শুনিয়াছি, এইবার আল্লাহ তাহা দেখাইয়াছে। কামান-বন্দুকের কথা শুনিয়াছি কিন্তু গতকল্য যাহা দেখিয়াছি তাহা আল্লার গজব ছাড়া আর কিছু নহে। এই পাঞ্জাবী পশুরা নিরীহ গ্রামবাসী মা-বোনের উপর অকথ্য অত্যাচার করিয়াছে, শরিয়তবিরোধী কার্যে লিপ্ত হইয়াছে। তাই আল্লাহতায়ালা এই গজবিয়াগো উরফে এক্কারে নারাজ অই গ্যাছে। নইলে কওচেন, হিগুন যাওন লাগছিল রাস্তার হরদি গাড়ী চালাইয়া, আচমবিৎ মাটির তলেতুন আওয়াজ করে কি একটা বারঅই হিগুনরে কিল্লাই ধ্বংস কল্লো! ইয়াতুন আর মনে অইচে ইগুনের উরফে আল্লার গজব নাজিল অইচে। আল্লা মজিবের উরফে রাজী অই গ্যাছে। মজিব এই যুদ্ধে জিতবো। নইলে আল্লার কিতাব মিইছা।”......

(নূরুল হক, এম-এন-এ)

  1. জাতীয় সংসদ সদস্যদের বক্তৃতামালা থেকে সংকলিত।