পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/১৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

138 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড মোট সম্পদের একটা অংশ INA ফৌজকে দান করেছিল। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির Kin’s Commission, প্রাপ্ত Major G.S. Dillon, শাহনাওয়াজের মত শত শত কমিশও অফিসার এবং হাজার হাজার জোয়ান ব্রিটিশ সরকারের চাকরি ও নিশ্চিত ভবিষ্যৎ ছেড়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের স্রোতে নিজদেরকে নিক্ষেপ করে আজাদ হিন্দু ফৌজে যোগ দিয়েছিল। ICS পরীক্ষায় প্রথম স্থান দখল করেও নেতাজী সুভাষ বসু যে চাকরি ত্যাগ করেছিলেন, তা কি বৃথা গিয়েছে? বস্তুতঃ এই সব বীরত্ব ও আত্মত্যাগ উপমহাদেশের আজাদী লাভকে তুরান্বিত করেছিল। আমার প্রিয় ধর্মভীরু দেশবাসীকে বলা প্রয়োজন যে, মিঃ জিন্নার পাকিস্তানের স্বাভাবিক মৃত্যুই হয়েছে। এবং এটাকে অপমৃত্যু বলা চলেনা। অবশ্য পাকিস্তানের জন্মটাকে কিছুটা অস্বাভাবিক বলা চলে। কাজেই এর প্রতি আর কারও কোন মোহ থাকা উচিত নহে? পাকিস্তানরূপী যে শিশুকে তিওয়ানা-নসরুলা কোম্পানীর স্বার্থে সে শিশুর দাবীদার সেজে প্রকৃত জন্মদাতা তথ্য নিরীহ ধৰ্মভীরু বাঙালীকে বিগত ২৪ বৎসর ধরে নানাভাবে শোষণ ও নির্যাতন করেছে। ইসলাম, সংহতি ও মুসলমানের নামে বহু অনৈসলামিক কারবার বেঈমানী ও ধোঁকাবাজি করেছে। ব্যবসায়ী স্বার্থে, সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে তারা ভাই বলে মুখে প্রচার করেছে কিন্তু পূর্ববঙ্গের মানুষকে কোনদিন তারা হৃদয়ে স্থান দেয়নি। লক্ষ লক্ষ বাঙালী বন্যায়-জলোচ্ছাসে-ঘূর্ণিঝড়ে শিয়ালকুকুরের মত প্রাণ দিয়েছে, কিন্তু পশ্চিমা শোষকচক্র, কখনও শোষণের যাতাকল বন্ধ করেনি। ১৯৬৪ সনে যখন পূর্ববাংলার এক মহকুমায়ই ১৮ হাজার লোক একরাত্রে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাসে প্রাণ হারিয়েছিল তখন তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান সফর করতে পূর্ববঙ্গে না এসে লণ্ডনে বেড়াতে গিয়েছিলেন। লণ্ডনের পত্রপত্রিকা ব্যঙ্গ করে লিখেছিলঃ 18 thousand people died, who cares? অর্থাৎ বিগত নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাস নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা ও পটুয়াখালীতেই যখন প্রায় ১০ লক্ষ নরনারীর মৃত্যু হয়েছিল, লক্ষ লক্ষ গৃহহারা সর্বহারা নরবারীর অগণিত মৃতদেহ পদ্মা-মেঘনা-যমুনাতে এমনকি Gunboat, Helicopter কোথায় ছিল? তদানীন্তন গভর্নর এডমিরাল আহসান বলেছিলেন, “আমি Islamabad-এর কাছে Helicopter চেয়েছিলাম- কিন্তু পাইনি।” সেই নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ের ধ্বংসলীলা পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে প্রলয়ঙ্কারী দুর্যোগ। লক্ষ লক্ষ দুর্দশাগ্রস্ত আদম সন্তানের করুণ আর্তনাদে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠেছিল। ভারতসহ দুনিয়ার প্রায় সব রাষ্ট্র হতে সাহায্য-সম্ভার এসেছিল, হেলিকপ্টার এসেছিল। তখনও পিণ্ডি-ইসলামাবাদশাহীর হৃদয় বিগলিত হয়নি। শত শত নর-নারীকে, স্ত্রী ও পুরষকে একসাথে কবরস্থ করা হয়েছিল। এমনকি হিন্দু-মুসলমানকে একসাথে এক গোরে দাফন করা হয়েছিল-কারণ দাফনের কাপড়েরও অনটন হয়েছিল। Gunboat ছিল না, অর্থ ছিল না। এক ফোঁটা পানি, এক মুঠো অন্ন ও লজ্জা নিবারণে এক টুকরো কাপড়ের জন্য লক্ষ লক্ষ আদম সন্তানের করুণ আর্তনাদে সারা দুনিয়া বিগলিত হয়েছিল, সাহায্য-সম্ভার নিয়ে এগিয়ে এসেছিল কিন্তু বিগলিত হয়নি আদমজী, ভালিকা, আমীর আলী, ফেন্সী, দাউদ ও গান্ধারা গোষ্ঠীর তথা পশ্চিমা ২২-পরিবারের হৃদয়। এর পরও আপনারা এদের ইসলামী দরদের ধোঁকামিতে বিশ্বাস করেন? এদের ইসলাম শোষণের যন্ত্রবিশেষ। আসলে এরা ইসলাম মানে না। ১৪ শত বৎসর পর্যন্ত প্রতি জুম্মাতে, ঈদে আপনারা খোতবায় শোনেন ان الله يأمر بالعدل والإحسان -আল্লাহ আদাল’ ও এহছানের কথা তথ্য ন্যায়বিচার ও ইনছাফের কথা, মঙ্গলের কথা বলেছেন; আর এই লুটেরা দসু্যদের পাক কোরানের এই নির্দেশ অমান্য করে যুগ যুগ ধরে বেইনসাফ ও বেঈমানী করেছে। ভাইসব, দুনিয়ার কোন রাষ্ট্রই শুধু ধর্মীয় বন্ধনের নামে বা দ্বিজাতিতত্ত্বের উপরে ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। জোর করে অবাস্তব ও অসম্ভবকে বেশীদিন টিকিয়ে রাখা যায় না। তাই বহুদিন জোড়াতালি দেওয়ার পর নকল পাকিস্তানের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। আর যদি কেহ মনে করেন পাকিস্তানের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে, তজ্জন্যও বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ বা পূর্ববঙ্গবাসী দায়ী নহে।