পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/১৭৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

|49 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড দেশী-বিদেশী নেতৃবর্গ, অফিসার ও সাংবাদিকদের কাছে সবচাইতে প্রিয় আলোচ্য বিষয় ছিল নির্বাচন ও শাসনতন্ত্র। অর্থাৎ বন্দুকধারী মানুষটির মধ্যে গণতন্ত্রের এক সুকুমার মূর্তি বিরাজ করছে, এটাই ছিল সমগ্র কিছুর প্রতিপাদ্য বিষয়। এক কথায় তিনি দানবের কাছ থেকে মানবীয় গুণাগুণ লাভের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু তবুও ঈশপের গল্পের সত্য তার মধ্য প্রকাশ পেতে থাকে। বিশেষ বিশেষ পশু বা পক্ষী ছদ্মবেশ ধারণ করে দীর্ঘ সময় যেমন নিজেকে লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হয় না, কণ্ঠস্বরই তার জন্যে অভিশাপ হয়ে ওঠে, তার পরিচয়কে ঘোষণা করে-ইয়াহিয়ার ব্যাপারেও তাই ঘটল। ক্রমবিকাশমান পাশবিক রূপটি সকলের কাছে স্পষ্ট হতে থাকে। তবে তিনি সুচতুরের ন্যায় বাক্যব্যয়ে শিক্ষিত। তখন পিণ্ডিতে ট্যাঙ্কগুলো ক্যান্টনমেন্টে ফিরে গিয়েছিল, রাস্তার মোড়ের কামানগুলোর নল মাথা নত করে স্তব্ধ। অসামরিক ও সামরিক স্টারধারী আমলদের রাজনৈতিক শাসনগত কাঠামো তখন অনেকটা সুপ্রতিষ্ঠিত। সে সময় ইয়াহিয়া সিভিলিয়ান পোশাকে ঢাকা সফরে আসলেন। হাতের ব্যাটন আর মূখনিঃসৃত সৌরভ বাদ দিলে তাকে সেদিন অন্ততঃ একজন মোনাফেক রাজনীতিকের মতো মনে হয়েছিল। সাংবাদিকরা বিমানবন্দরে তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট দ্য গলের পদত্যাগের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে দেশব্যাপী এক রেফারোণ্ডামে দ্য গল পরাজিত হয়ে সেদিনকার পত্রিকাতেই পদত্যাগের কথা ঘোষণা করেছিলেন। প্রশ্ন ছিলঃ দ্য গলের এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কি? জেনারেল ইয়াহিয়া খান হাতের ব্যাটন বা হাতের তালুতে দু’বার সুকে বিজ্ঞের ন্যায় মন্তব্য করেনঃ যে কোন সম্মানীয় নেতার পক্ষে এটাই হচ্ছে গৌরবজনক পথ। আবার প্রশ্নঃ পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও কি এ কথা প্রযোজ্য? এ প্রশ্ন যে তির্যকভাবে তাকেই আঘাত করছে, তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। ক্রোধ সংবরণ করে প্রশ্নকারী রিপোটারের কাঁধে হাত রেখে দ্রুত উত্তর দেন ইয়েস-মানে ‘হ্য’। এটা যে তার দিক থেকে প্রতিশ্রুতি ছিল, সে কথা এই সিপাহীর মস্তিষ্কে আসেনি। কিন্তু রিপোর্টারগণ বুঝতে পেরেছিলেন কোথায় তার আঘাত লাগে। ক্রমান্বয়ে ক্ষণিকের এই ছদ্মবেশীর ময়ূরপুচ্ছ খসে পড়তে থাকে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রবঞ্চনাপূর্ণ বক্যসম্ভারের ছিদ্রপথে তিনি জনগণের বিরুদ্ধে অস্ত্র চালানোর তথ্য প্রকাশ করতে থাকেন- রিপোর্টারের কাঁধে তিনি হাত রেখে “গৌরবজনক পথ অবলম্বনের’’ প্রতিশ্রুতি তখন থেকেই তার কানে ব্যঙ্গ’র মতো শোনাতে । পিণ্ডির এক সংবর্ধনা সভায় ঘনিষ্ঠ মহলের আলোচনায় ইয়াহিয়া অস্ত্রে শান দেওয়ার তথ্য সগৌরবে ফাঁস করেন। তিনি বা হাতের অমৃত্যাধার উর্ধ্বে তুলে ডান হাতের অঙ্গুলি নির্দেশে বলেনঃ আইয়ুব খান ক্ষমতায় এসেছিলেন মুষ্টিবদ্ধ হাতে- বিদায়ের সময় মুষ্টি খুলে তাকে চলে যেতে হয়েছে। আর আমি এসেছি মুষ্টি খুলে, কালক্রমে আমার হাত মুষ্টিবদ্ধ হবে। কথাটা শুনে জী-হুজুর পরিষদ নিম্প্রয়োজনে হেসে উঠেছিলেন, সুযোগসন্ধানী রাজনৈতিক নেতারা বিচলিত হয়ে পড়বেন- কিন্তু জনসাধারণ তার এই বক্তব্যে মোটেই বিস্মিত হননি। তারা জানতেন ডিক্টেটর সেনাপতি কোন পথ নেবেন, তার শাসনের পথ কোনটি, ক্ষমতার স্থির থাকার জন্যে তার হাতের অস্ত্রের নাম কি। আর এক দুস্য জেনারেলের ‘‘অস্ত্রের ভাষা” সম্পর্কে তারা সচেতন। নির্বচনের আয়োজন ও বিলম্বিত ব্যবস্থার পরও জনগণ ও দেশপ্রেমিক রাজনীতিকগণ ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্নে ইয়াহিয়াকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতেন না। তবুও সামরিক আইনের মধ্যেই জনগণ ইয়াহিয়ার স্বপ্নকে চুরমার করে এক ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করেন। সামরিক শাসকগোষ্ঠীর গুপ্ত বাহিনীর রিপোট ছিল আওয়ামী লীগ