বস্তুতঃপক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশের শোষণহীন সমাজব্যবস্থার অর্থনৈতিক কাঠামোটি কি ধরনের দাঁড়াবে তার একটি মোটামুটি রূপরেখা দেয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে। এতে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের জন্য ব্যাঙ্ক, বীমা ভারী ও বৃহৎ শিল্পসহ পাট, তুলা, কয়লা, লৌহ প্রভৃতি সমেত আমদানীরফতানী বাণিজ্য রাষ্ট্রায়ত্ত্বকরণের কথা বলা হয়েছে। ভূমিব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধন এবং কর কাঠামোর প্রগতিশীল রূপায়নের দিকও নির্দেশিত হয়েছে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টেতে। যেহেতু বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান ও কৃষিনির্ভর দেশ সেহেতু গ্রামবাংলার উন্নয়ন তথা কৃষির পক্ষে কল্যাণকর ব্যবস্থা ছাড়া অর্থনৈতিক বৈপ্লবিক রূপায়ণ প্রায় অসম্ভব বলা চলে। দারিদ্র্য তার সর্বগ্রাসী সংহার মূর্তি নিয়ে সর্বত্র সমান ছায়া ফেললেও পাকিস্তানী শাসকদের ঔপনিবেশিক নীতির ফলে বাংলাদেশের গ্রামবাংলার চেহারা আজ ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। পাকিস্তানী শোষকরা দরিদ্র কৃষককুলের কল্যাণের জন্য কোন ব্যবস্থা তো গ্রহণ করেইনি বরং এমন সমস্ত ব্যবস্থা নিয়েছে যাতে ভূমিহীন কৃষকের হাতে এককাঠা জমি না যায়। এক সময়ে ভূমির সর্বোচ্চ সীমা পরিবারপ্রতি ৩৩ একর নির্ধারণ করে যে আইন পাশ করা হয়েছিল, জল্লাদ ইয়াহিয়ার গুরদেব আইয়ুব খাঁ তা রদ করে ১২৪ একরে নির্ধারণ করে। যার ফলে উদ্ধূত্ত ভূমি বাংলাদেশে বণ্টনের সম্ভাবনা চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। তাই আজকে বাংলাদেশের মেহনতি কৃষকসমাজের ৭৬ শতাংশ হয় ভূমিহীন আর না হয় নিতান্তই গরীব। পশ্চিম পাকিস্তানী সামন্ত ভূস্বামী একচেটিয়া পুঁজিপতিদের সীমাহীন শোষণের ফলে বাংলাদেশের কৃষকের ঋণের পরিমাণ শুধু সরকারের কাছে দাঁড়ায় একশো কোটি টাকার উপরে। জোতদার ও মহাজনী ঋণের পরিমাণ তাতে ধরা হয়নি। আর কৃষকদের মধ্যে এই মহাজনী ঋণের পরিমাণ যে কত ব্যাপক তা সকলেরই জানা আছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ আবাদী জমিও এদের কবজার মধ্যে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এই যে, বাংলাদেশের শস্যভাণ্ডার বলে বিবেচিত জেলাগুলো- সিলেট, ময়মনসিংহ, রংপুর, রাজশাহী, দিনাজপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনার দক্ষিণাঞ্চলে মহাজনী ও জোতদারী শোষণের রূপটা সবচেয়ে প্রকট। এই সমস্ত অন্যায় ও অবিচার অবসানের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টেতে। ভূমিব্যবস্থাকে এমনভাবে পুনর্বিন্যাসের কথা বলা হয়েছে যাতে সত্যিকারের কৃষক উপকৃত হয়। বর্তমান ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার বিলোপ সাধনের উদ্দেশ্যে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমি করমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে এবং এই পরিমাণ জমির জন্য বকেয়া কোন খাজনা দিতে হবে না বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো সম্পূর্ণ শোষণমুক্ত করে কৃষক-শ্রমিক মধ্যবিত্ত-ব্যবসায়ী তথা আপামর জনসাধারণের জন্য এক সুখী-সমৃদ্ধিশালী সমাজ গঠনের দায়িত্ব আজ সকলের। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যেই মুক্তাঞ্চলে বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করার কাজ হাতে নিয়েছেন। নয়া জামানার নতুন নকীবদের কণ্ঠে ধ্বনিত হোক আজ নবজীবনের শপথ, নতুন সমাজ গঠনের রণতূর্য।
রক্তের অক্ষরে লিখি[১]
১৪ নভেম্বর, ১৯৭১
শান্তির ললিতবাণী যাদের কাছে পরিহাসের সামগ্রী, সেই দানবের সঙ্গে সংগ্রামের তরে সংগ্রামীরা ঘরে ঘরে প্রস্তুত হচ্ছে- এই সংবাদ রবীন্দ্রনাথ আমাদের দিয়েছিলেন বহু বছর আগে। আজ বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে আমরা অনুভব করছি সংগ্রামীদের পদচারণা, বীরের মতো তারা যুদ্ধ করছে শত্রুর সঙ্গে, প্রাণ দিচ্ছে অকাতরে প্রাণ দেয়া-নেয়ার এই উৎসবের মধ্য দিয়ে তারা আমাদের সোনার বাংলা ও তার শান্তিপ্রিয় মানুষকে সুখের মধ্যে
- ↑ ‘রক্তের অক্ষরে লিখি' শীর্ষক ধারাবাহিক কথিকাগুলি 'জাফর সাদেক' ছদ্মনামে মোহাম্মদ আবু জাফর রচিত।