পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/২০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

176 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড প্রতিষ্ঠার সাথে ফলগুধারার সেই বাঁধটি খুলে গেছে, যা প্রতিনিয়ত পিষে মারছিলো বাঙালীর সঞ্জীবনী শক্তিকে। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশকে পঙ্গু করে রাখার জন্য, সামাজিকভাবে কোণঠাসা করার জন্য একের পর এক চক্রান্তের জালে বুনেছে পশ্চিম পাকিস্তানের সামন্ত সামরিক চক্র। বাংলা ভাষা, বাংলার সংস্কৃতি, সাহিত্য ও ঐতিহ্যকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য আঘাত এসেছে একের পর এক। এসবের প্রতিবিধান দাবী করে বাঙালী পেয়েছে শুধু বুলেট। ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্টের অব্যবহিত পরেই পাকিস্তান পরিষদের প্রথম অধিবেশনেই স্বাধীনতা সংগ্রামে পাঞ্জাবী-বেলুচ, পাঠান-সিন্ধী সকলের অবস্থানের কথা সাড়ম্বরে ঘোষণা করা হয়েছিল। স্বীকৃত পায়নি শুধু বাংলার মানুষ। ভাগ্যের এ এক নিদারুণ পরিহাস। দেশে জনসংখ্যার যারা শতকরা ৫৬ ভাগ, যাদের ভোটের জোরে পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছিল- রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সকল ধ্যান ধারণা বিসর্জন দিয়ে অতীব কৃত্রিম একটি কাঠামোর উপর ভিত্তি করে তারাই হলো অবহেলিত। অবজ্ঞা আর বঞ্চনার হোল শুরু। সদ্য স্বাধীন বাংলার রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন উঠলো। সদৰ্পে ঘোষণা করা হলো- উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। আর একথা বাঙলা মুলুকে সরবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। কর্ণধাররা ড্যাকোটা বিমানে চেপে ঢাকা এলেন। প্রতিবাদ জানালো ঢাকার ছাত্রসমাজ। মুসলিম লীগের দোর্দণ্ড প্রতাপের সেই দিনগুলিতেও ছাত্ররা পুলিশ বাহিনী আর গুণ্ডাদলের সম্মিলিত হামলার মাধ্যমে এই প্রতিবাদের কণ্ঠ স্তব্ধ করার চেষ্টা হলেও শাসকগোষ্ঠী সাময়িকভাবে তখন প্রশ্নটিকে ধামাচাপা দিয়েছিল। এলো রক্তস্নাত ১৯৫২ সাল। শাসনতন্ত্রের মুসলিম লীগ সংক্রান্ত বিষয়ে আবার এলো রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন। গোলাম মোহাম্মদ-নাজিমুদ্দীন গোষ্ঠী আবার বাংলার মানুষের উপর চাপিয়ে দিতে চাইলো উর্দুর বোঝা এবার ছাত্র-জনতা পথে নামলে ফেষ্ট্রন-ব্যানারপ্লাকার্ড নিয়ে। রাজপথ হলো প্রকম্পিত। বিধিনিষিধের বেড়াজাল গেল উড়ে। খুনী নুরুল আমিনের পুলিশের গুলিতে বরকত-সালমসহ শাহাদাতবরণ করলেন বহু ছাত্র। জনতা গর্জে উঠলো “আমরা সালামের ভাই! আমরা বরকতের ভাই!” সেই গর্জন ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো শহরে-বন্দরে, গ্রাম-গঞ্জে, কলেকারখানায়, হাটে-মাঠে। একের পর এক সর্বদলীয় সমাবেশ ঘটতে থাকলো কুখ্যাত মূলনীতি কমিশন রিপোটের বিরুদ্ধে। জনতার একবাক্যে রায়-মানি না। এলো নির্বাচন। পূর্ব বাংলার মানুষ আইনসভায় নিজেদের বক্তব্য পেশের সুযোগ পেলেন। গঠিত হোলো যুক্তফ্রন্ট- শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদী ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে। শাসক মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগসহ ছোটখাটো অনেকেই শরীক হলেন এ যুক্তফ্রন্টে। নির্বচনী রায়ে দেখা গেল পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগের সমাধি রচিত হয়েছে। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠিত হলো। কিন্তু শেরে বাংলা ফজলুল হক বাংলাদেশের স্বার্থে যখনই কিছু করতে ও বলতে শুরু করলেন তখন পশ্চিম পাকিস্তানী কায়েমী স্বার্থবাদী মহল ষড়যন্ত্রের জাল বুনে তা নস্যাৎ করে দিল। ৯২ (ক) ধারাবলে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে ভেঙ্গে দেওয়া হোল। পরবর্তী বছরগুলিতে বুড়ীগঙ্গার অনেক পানি বয়ে গেছে। বাঙালীর রক্তে রমনার কৃষ্ণচূড়া গুচ্ছ আরো লাল হয়েছে। কিন্তু চক্রান্তের রাজনীতি শেষ হয়নি। মরহুম সোহরাওয়াদী চেয়েছিলেন এবং বাস্তব পদক্ষেপের মাধ্যমে চেষ্টা করছিলেন পশ্চিমী সামন্ত সামরিক গোষ্ঠীর একমাত্র উপজীব্য ষড়যন্ত্রের প্রাসাদ রাজনীতিকে সার্বজনীন ভোটধিকারের ভিত্তিতে দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে খতম করার। এবারে দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের সকল আশা-আকাঙ্খা নস্যাৎ করার জন্য সেনাবাহিনী সরাসরি এগিয়ে এলো। সামরিক শাসক আইয়ুব খাঁর অধিনায়কত্বে এবং তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্রের যাতাকলে নিষ্পেষিত হলো সারাদেশ দীর্ঘ দশ বৎসর যাবৎ আইয়ুবী আমলের এই কালো দশকে বাংলার মানুষের জাতীয় সত্তার প্রতিটি তন্তু ছিড়ে টুকরো টুকরো করার নিস্ফল চেষ্টা হয়েছে বারবার। শত শত ছাত্র যুবককৃষক-শ্রমিককে হত্যা করা হয়েছে গুলি করে। আটক করা হয়েছে হাজার হাজার দেশগ্রেমিক নাগরিককে। বাংলা ভাষা