পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/২০৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

179 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড সেদিনও তোরণ যথারীতি বসে বসে হুকো টানছিল। বন্দুক হাতে জনাতিনেক লোক তার কাছে এসে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল, চরের কোন অঞ্চলটায় ভাল পাখী পাওয়া যায় এবং এর জন্য তোরণকে তারা সঙ্গে নিতে চায়। উপযুক্ত পারিশ্রমিকেরও কথাও তারা উল্লেখ করল। তোরণ বন্দুক কোনদিন নিয়ে পর্যন্ত দেখেনি। চট করে তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। বলল, “যাবার পারুম এক শর্তোত, হামাক বন্দুক মারা শিখাবার নাগিবে।” যে ভদ্রলোক কালো একটা ওভারকোট গায়ে দিয়েছিলেন তিনি হেসে উঠলেন। মাছ মেরে শখ মেটে না, পাখী মারার ভীষণ শখ তাই না? তোরণ কোন উত্তর দেয়নি, ভদ্রলোকরা রাজী হয়ে গেল। সেদিনই সে প্রথম বন্দুক ছুড়লো। লাল একটা কার্তুজ ভরে যখন তার হাতে বন্দুকটা দিল তখন সে নতুন একটা অভিজ্ঞতা অর্জনের আনন্দে কেঁপে উঠেছিল, কিছুটা ভয়ও করেছিল। নির্দেশমত বাঁটটা বুকের কাছে শক্ত করে ধরে ট্রিগারটা ডানহাতের আঙ্গুল দিয়ে চেপে দিয়েছিল। এখনও সেই দিনের কথা ভাবলে তোরণের নাকে বারুদের গন্ধ এসে লাগে। এলাকায় শিকারীদের নিয়ে যেত। তারপর দুপুরবেলা মাছ ধরার ডেরায় ফিরে আসত। ভোরে গঞ্জে যাওয়া বৃদ্ধ পরান দুপুর গড়িয়ে গেলে ফিরে আসত। আসার সময় বাড়ি থেকে খেয়ে আসত। পরান ফিরে এলেই তোরণ বাড়িতে ফিরে যেত। আবার সন্ধ্যেবেলায় দিকে কিছুক্ষণের জন্য আসত-তারপর আবার সেই ভোরের দিকে। মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পের বাইরে বসে এক এক করে সব কথা মনে পড়ল। কবে তার বাবা মরে গিয়েছিল। কবে একবার নদীর পাঁকে পড়ে ডুবতে ডুবতে আশ্চর্যভাবে বেঁচে এসেছিল, একবার মাছের ডেরা ফেলে সারা রাত যাত্রা শোনার জন্য বুড়ো পরান মাঝি তাকে ভীষণ মেরেছিল । সব কথা এক এক করে মনে পড়ছে। কিন্তু একদিনের কথা তোরণ কিছুতেই ভুলতে পারে না। একদিন দেখল অসংখ্য নৌকায় চড়ে দলে দলে সব লোক যাচেছ জিজ্ঞেস করে জানতে পারল কুড়িগ্রামে নাকি বিরাট মিটিং-শেখ মুজিব বক্তৃতা করবেন। অতি পরিচিত নামটা শুনে তোরণ যেন সম্মোহিত হয়ে গেল। বলে কয়ে কুড়িগ্রামমুখী একটা নৌকায় উঠে বসল। এখনও মনে পড়ছে কি সে মিটিং লক্ষ লক্ষ লোক যেন ফেটে পড়তে চাইছে। অসংখ্য স্পীকার লাগান হয়েছে। ভিড়ে দম বন্ধ হয়ে আসার যোগাড়। শেখ মুজিব বক্তৃতা দিলেন, বাংলার কথা বললেন, বাংলার মানুষের কথা বললেন। তোরণ নিম্পলক দৃষ্টিতে সমস্ত বক্তৃতা শুনলো। মিটিং ভাঙ্গলে মুষলধারে বৃষ্টি নামল। বৃষ্টির মধ্যে ভিজে ফিরতি কোন এক নৌকায় ফিরে এসেছিল। ভোররাতের দিকে তাকে ঘাটে নামিয়ে দিল। তোরণ ভয়ে ভয়ে মছের ডেরায় ফিরে এসে দেখলো ছই-এর নীচে পরান চাচা নেই। সে অবাক হয়ে গেল। এরকম একটা ব্যতিক্রম পরান মাঝির জীবনে নেই বললে চলে। ভোরের দিকে মাঝি ফিরে এলো। জিজ্ঞেস করে জানতে পেলো পরান মাঝিও মিটিং -এ গিয়েছিল। মাছের ডেরা ফেলে মিটিং-এ যাওয়া পরান মাঝির জীবনে এই প্রথম। তোরণের জীবন থেকে একটা একটা দিন প্রতিদিনের মত খসে যেতে লাগল। এক সময় সারা দেশ জুড়ে ভোট হল, শেখ মুজিব নির্বাচিত হলেন । তারপর বাংলার বুকে খুব দ্রুত কতকগুলো দৃশ্যান্তর ঘটে গেল। ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর না করার চক্রান্ত ফাঁদলেন। আবার নতুন করে শুরু হল শ্লোগান, মিটিং, পোষ্টার, ব্যানার। ঢাকায় শেখ মুজিবের সাথে ইয়াহিয়া-ভুট্টোর বৈঠক বসল। গঞ্জ থেকে ফিরে আসা লেকাজনের কাছ থেকে সব খবরই সে পেত। কিন্তু পরান মাঝি বিশ্বাস করত না। তোরণও বিশ্বাস করত না। ভোট দিনু যাক’ ক্ষমতাও যাবার নয় এটা হবার পারে না।” পরান মাঝি তখন নিশ্চিন্তে ডেরা নিয়ে ব্যস্ত।