পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/২০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

180 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড একদিন দেখল গঞ্জ থেকে ফিরে আসা লোকগুলো খুব উত্তেজিত। প্রায় প্রত্যেকের হাতে একটা করে পত্রিকা। গ্রামের ছাত্ররা দল বেঁধে যেন দিন-রাত কিসব সলাপরামর্শ করে। থানায় পুলিশদের মধ্যেও এ কি উত্তেজনা। তারপর একদিন দুপুর গাড়িয়ে বিকেল হ’ল-বিকেল গড়িয়া সন্ধ্যা। ভোরে গঞ্জের দিকে বেরিয়ে যাওয়া পরান মাঝি ফিরে এলো না। অন্যান্য দিন গঞ্জ থেকে সারি সারি নৌকা ফিরতো। সেসবও দেখা গেল না। রাত্রিবেলার দিকে সে মাঝির বাড়িতে গিয়ে দেখা করল। না, তখনও মাঝি ফেরেনি। তারপর রাত আরও বাড়লে গঞ্জ থেকে পালিয়ে আসা একজনের কাছ থেকে জানতে পারলাম বন্দরের উপর পশ্চিমা সৈন্যবাহিনী প্রচণ্ড গুলি চালিয়েছে। তোরণ মুহুর্তেই ভেঙ্গে পড়ল। কোন দুর্ঘটনা না ঘটলে পরান মাঝি নিশ্চয়ই ফিরে আসত। পরের দিন তোরণ গঞ্জের দিকে রওয়ানা দিল। স্কুলবাড়ির থেকে একটু দুরে পাটের গুদামের পাশ দিয়ে গঞ্জের ভেতর ঢুকতে যাবে এমন সময় সমস্ত গা ছমছম করে উঠল। একটা লোকজন নেই। সমস্ত দোকানপাট বন্ধ। আর একটু অগ্রসর হতেই দেখতে পেল বাজারে পোড়া ধ্বংসাবশেষ। তোরণের আর ভেতরে ঢোকার সাহস হয়নি। জোরে পা চালিয়ে বেরিয়ে সোজা গ্রামে চলে এসেছিল। তোরণের এখন অন্য জীবন শুরু হয়েছে। বসে বসে পরান মাঝির চোখ দুটোর কথা মনে করল। সেই চোখ দুটো থেকে তোরণের জন্য সবসময় স্নেহ ঝরে পড়ত। না, পরান মাঝি আর গঞ্জ থেকে ফিরে আসেনি। সব বুঝতে পেরে তোরণ মাছের ডেরার পাশে গ্রামে চলে এসেছিল। তারপর পশ্চিমা সৈন্যরা ক্রমে ক্রমে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। একদিন তোরণ মাছের ডেরায় কাজ করছিল, এমন সময় তাদের গ্রামের দিক থেকে গুলির শব্দ শুনতে পেল। তোরণের ছেড়া জাল মেরামত করা বন্ধ হয়ে গেল। সে খুব ভয় পেয়েছে। ঘণ্টা খানেক পর গুলির শব্দ থেমে গেল। বাড়িতে ফেরার সময় বার বার কেন যেন পরান চাচার কথা মনে পড়ল। গঞ্জে গুলি হয়েছিল। পরান চাচা আর ফিরে আসেনি। মা, পরান চাচার বউ এখনও কি বেঁচে আছে? ঘাটে নৌকো পেল না। পশ্চিমা দসু্যরা নৌকো ডুবিয়ে দিয়েছে। সাঁতারে তোরণ নদী পার হ’ল। তোরণ এখন মুক্তিযোদ্ধা। গতকাল একটা অপারেশনে গিয়েছিল। আবার আগামীকাল রাতের অন্ধাকারে পশ্চিমা দসু্যদের খোঁজে গ্রেনেড, এল-এম-জি নিয়ে কয়েকজন মিলে যেতে হবে। আজ রাতটা শুধু একটুখানি বিশ্রাম। ক্যাম্পের বাইরে একটা অন্ধকারে গাছের নীচে বসে বসে তোরণ এইসব ভাবছিল। সাঁতরে তোরণ নদী পার হয়ে কাছাকাছি আসতেই সে মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে মাটিতে বসে পড়েছিল। গ্রামের ঘরগুলো পুড়ে ছাই হয়ে মাটির সাথে মিশে গেছে। ঠিক শ্মশানের পরিত্যক্ত চিতার মত। গ্রামের ভেতর ঢুকে দেখতে পেল গুলি চালনার সময় যারা পালিয়ে বেঁচেছিল তারা ফিরে এসে ছাইয়ের ভেতর থেকে তাদের আপনজনের মৃত লাশ খুঁজছে। তোরণ পাগলের মত দৌড়ে তার বাড়ির দিকে ছুটে গেল। ভিটের উপর তার মায়ের চিহ্ন খুঁজে পেল না। তারপর বাড়ির আশেপাশের ফিরে আসা দু’চারজন লোককে জিজ্ঞেস করল। তারা কেউ কিছু বলতে পারল না। তোরণ পাগলের মত বাড়ির পেছনের বাঁশঝাড়ের ভেতর ঢুকে পড়ল। এমনও তো হতে পারে গুলি খেয়ে বাঁশঝাড়ে ঢুকে সেখানেই মারা গেছে। তন্নতন্ন করে সেখানে খুঁজতে লাগল। সেখানেও পেল না। তারপর বাড়ির থেকে আরও দূরে খুঁজতে বেরিয়ে গেল। ক্যাম্পের বাইরে বসে থাকা তোরণের চোখ দিয়ে দু’ফোটা উত্তপ্ত অশ্রু বেরিয়ে পড়ল। তাদের গ্রাম থেকে আধা মাইল খানেক দূরে একটা আমবাগানে আছে। তারি ভেতর তার মায়ের লাশের পাশে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়েছিল তোরণ।