পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/২০৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

182 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড মুসলমান বণিক শ্রেণী, যারা সে সময় ভারতবর্ষের অন্যান্য বণিক শ্রেণীর কাছে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়েছিলো। বাংলাদেশের মানুষকে বোঝানো হয়েছিলোঃ যেহেতু বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সম্প্রদায় মূলতঃ কৃষিজীবী, সেই কারণে তাদের মুক্তি নিহত আছে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু অমুসলমান জমিদার, জোতদার ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত অমুসলমানদের উৎখাতের মধ্যে। মুসলিম লীগ বাংলাদেশে এই সাম্প্রদায়িক প্রচার জোরদার করে কাজ হাসিল করে নিল। আসল উদ্দেশ্য ছিলো দেশের অর্থাৎ গোটা পাকিস্তানের জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগের বাসস্থান বাংলাদেশকে বর্তমান পশ্চিম পাকিস্তান এবং ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত উদ্বাস্তু বণিক শ্রেণীর একটি স্থায়ী উপনিবেশে পরিণত করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, সরলপ্রাণ বাংলাদেশের মানুষ প্রথম দিকে তাদের এই গোপন দুরভিসন্ধি ধরতে পারেনি। তারা আশা করেছিলো দেশ ভাগ হলে সামন্ত ও আমলাদের হাত থেকে তারা মুক্তি পাবে। সোনার বাংলা তার হৃত শ্রী আবার ফিরে পাবে। এই আশাতেই বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু মুসলমান সম্প্রদায় মুসলিম লীগকে প্রথম দিকে সমর্থন করেছিলো। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকেই পাকিস্তানের অবাঙালী কায়েমী স্বার্থবাদী ও পুঁজিপতিদের আসল রুপ প্রকাশ হয়ে পড়ে। কিন্তু প্রকাশ পেলেও শুরু থেকে বাংলাদেশের আপামর সাধারণের মধ্যে ব্যাপকভাবে তার প্রক্রিয়া হতে থাকে। বাংলাদেশের সচেতন ছাত্রসমাজ ও বুদ্ধিজীবী মহলের মধ্যেই তা সীমিত ছিলো। এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনও ওই পর্যায়ের মধ্যেই আবর্তিত হচ্ছিলো। পাকিস্তানী কায়েমী স্বার্থবাদীরা কিন্তু শুরুতেই আর একটা খেলা খেলেছিলো। সেটা হলো ভারত-বিরোধী সাম্প্রদায়িক প্রচার এবং আসল উদ্দেশ্যে সিদ্ধির জন্যে এই সাম্প্রদায়িক প্রচারকে স্থায়ী করতে তারা ১৯৮৪ সালে কাশীর আক্রমণ করে। জন্মলগ্নে কাশীর নিয়ে ভারতের সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগের পক্ষে একটা সুবিধে হয়ে গেল। তারা কাশ্মীরকে পাকিস্তানের প্রথম এবং প্রধান জাতীয় সমস্যারূপে চিহ্নিত করলো। এবং কাশ্মীর সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে তারা দেশের চিন্তা-ভাবনা, রাজনীতি, অর্থনীতি সমাজনীতি প্রভৃতি সবকিছুই যাচাই করতে লাগলো। প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগ নেতারা কাশ্মীরের দোহাই দিয়ে এগুতে লাগলো তাদের আসল উদ্দেশ্যের পথে। এর মধ্যে তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি ও ক্ষমতার ভাগবোটোয়ারা নিয়ে আত্মকলহ যে বাধেনি তা নয় । বরং বলা যায় তাদের নিজেদের মধ্যকার কলহ-বিবাদ চরমে পৌছেছিলো, আর তারই ফলশ্রুতি হিসেবে দেশে ঘটলো সামরিক অভু্যত্থান। গজিয়ে ওঠা পুঁজিপতি ও আমলারাও তথাকথিত নেতাদের ঝগড়া-বিবাদ ও কামড়াকামড়িতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে সমারিক শাসনকে সমর্থন করে চললো। তারা সাপমরিক শাসনের সাহায্যে নিয়ে রাতারাতি ফুলে উঠতে লাগলো। ক্রমে ক্রমে বাংলাদেশকে পশ্চিমক পাকিস্তানের একটি লাভজনক উপনিবেশে পরিণত করার সব রকম আয়োজন তারা গ্রহণ করলো। আইয়ুবের ছত্ৰচ্ছায়ায় অর্থাৎ আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের ছত্ৰচ্ছায়ায় তাদের গতি হলো অপ্রতিরোধ্য। অন্যদিকে এই দীর্ঘকালীন সামরিক শাসনে দেশের গণআন্দোলনের সর্বনাশ করা হলো। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলাদেশে যে গণআন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছিলো আইয়ুব তাকে গুড়ো করে দিলো। পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্ৰীয় কাঠামোয় বাংলাদেশকে বঞ্চিত করতে চেষ্টা করা হয়। গোটা দেশের সমস্ত চিন্তা-ভাবনা সাম্প্রদায়িককতা ও ভারতবিদ্বেষের প্লাবন বইতে দিয়ে তারা এপথে এগিয়েছে। সচেতন বাঙালীরা যে এ সম্পর্কে কিছু জানতে পারেননি তা নয়, কিন্তু জানতে পারলেও পশ্চিম পাকিস্তানী কায়েমী স্বার্থবাদীদের চক্রান্ত ও উগ্র সাম্প্রদায়িকতার প্লাবনের মুখে তাদের করার কিছু ছিলো না। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় বাংলাদেশকে যে কিভাবে বঞ্চিত করা হয়েছিলো তার প্রথম একটা চিত্র পাওয়া গেল আইয়ুবের শাসনামলে ১৯৬৩ সালে। এই সময় সেনাবাহিনীর অফিসারদের মধ্যে বাঙালীদের সংখ্যা ছিলো শতকরা ৫ ভাগ, বিমান বাহিনীতে ছিলো শতকরা ৩ থেকে ৪ ভাগ এবং নৌবাহিনীতে ছিলো শতকরা ৩ ভাগ। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও বাংলাদেশকে পুরোপুরি ফাঁকি দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হওয়া সত্বেও এর কৃষি উন্নয়নের জন্যে কোন রকম ব্যবস্থা করা হয়নি। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তান-অনুর্বর অনাবাদী পশ্চিম পাকিস্তানকে কৃষি ও খাদ্যশস্যে স্বনির্ভর করে তোলার জন্যে