পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/২১০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

186 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড পাকিস্তানী হানাদারদের তথাকথিত রাষ্ট্রীয় সংহতির পরিকল্পনা আমরা দেখতে পাচ্ছি। তারা শহীদ মিনারগুলো ধ্বংস করে নিজেদের পদলেহী কিছুসংখ্যক গরুচোর দিয়ে সেখানে নামাজ পড়াচ্ছে। অর্থাৎ ওইসব জায়গার এক-একটা মসজিদের দাবী খাড়া করানো হচ্ছে। মজার ব্যাপার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটগাছটিকেও তারা নির্মুল করে উপড়ে ফেলেছে। যেন ওই বটগাছের ডালগুলোতেই বাঙালী জাতীয়তাবাদীরা ট্রাপীজ খেলতো। বাংলাদেশে হিন্দুর অস্তিত্ব পাকিস্তানী সংহতির পরিপন্থী। কাজেই তাবৎ হিন্দুকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। যারা পালিয়ে বেঁচেছে তারা এখানে ওখানে লুকিয়ে থাকছে কিন্তু একজনেরও সম্পত্তি নিজেদের দখলে নেই, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাঙালী এবং কোন কোন ক্ষেত্রে মুসলিম লীগের পেশাদার বাঙালী গুপ্তারা সেগুলো দখল করে বসে আছে। তাই যখন ইয়াহিয়া খান বাঙালী হিন্দুদের নিজেদের বাড়িতে ফিরে আসার জন্যে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে তথা অতি দুঃখেও হাসি পাচ্ছে এই ভেবে যে, হিন্দুরা তো আসবে কিন্তু উঠবে কোথায়? নিজের নিজের বাড়ি বলতে যা বেঝাতো সে তো পুড়ে-জুলে খাক। যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তা-ও কি আর খালি আছে?... হিন্দুর মন্দির ভেঙ্গে মাটির বরাবর করা হচ্ছে তা-ও দেখছি চোখের সামনে। বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন এলাকার লক্ষ লক্ষ বাঙালী মুসলমানদের সম্পত্তি এখন অবাঙালীদের দখলে। ঢাকার মীরপুরমোহাম্মদপুর থেকে বাঙালী খেদানো এবং নির্বিচারে বাঙালী নিধন শুরু হয়েছে ২৩ শে মার্চ থেকে। ওই দুটি অঞ্চলের তাবৎ বাঙালীর সম্পত্তি লুষ্ঠিত এবং অবাঙালীদের অধিকৃত। ভারতে শরণার্থী বাঙালী মুসলমানেরা ফিরে এলে যথাসময়ে ওইসব অবাঙালীদের অস্ত্রের শিকার হবে। আঠারো থেকে তিরিশ বছর বয়সের হাজার হাজার বাঙালী ছাত্র যুবককে পাকিস্তানী ঘাতকরা ধরে নিয়ে গিয়েছে এবং তাদের অধিকাংশকেই মেরে ফেলেছে। এখনও ধরে নিয়ে যাচ্ছে, হয়তো মেরেও ফেলেছে। উদ্দেশ্য, সক্ষম বাঙালী যুবকদের খতম করে বাঙালীদের বাহুবল ভেঙ্গে দেওয়া। রবীন্দ্রনাথের দেয়া ভারতীয় সংহতির চোহারা- “শক হুনদল পাঠান মোগল এবং দেহের হলো লীন”- আমরা দেখলাম, পাকিস্তানী সংহতি কসরতে হানাদার সেনাবাহিনীর পাঞ্জাবী পাঠান বিহারী বালুচ অফিসার জওয়ান পাইকার হারে অপহৃতা বাঙালী নারীদেহে লীন হচ্ছে। দূরপ্রসারী অভিসন্ধি হয়তো একটি মিশ্র জেনারেশন সৃষ্টি করা। সেটা রোধ করতে গেলে আমার আশঙ্কা, যে পরিমাণ গর্ভপাতের প্রয়োজ হবে তাতে প্রদেশের বিভিন্ন এলাকায় মেটারনিটি ক্লিনিকের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং বিদেশ থেকে শত শত বিশেষজ্ঞ ধাত্রী আমদানি অপরিহার্য। আজ এদেশে পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ আমদানি হচ্ছে। বাঙালী অফিসার অবাঞ্ছিত তাদের মেরে ফেলা এবং আধা-বাঞ্ছিতদের বিষদাঁত ভাঙ্গার জন্যে জেলে পোরার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সেই একই ব্যবস্থা হবে শিক্ষক, সংস্কৃতিবিদ এবং সাহিত্যকদের ক্ষেত্রেও। ফলে গড়ে উঠছে অবাঙালী তাঁবেদার গোষ্ঠী এবং সুবিধাভোগী বাঙালী মীরজাফর শ্রেণী। বাংলা ভাষার মর্যাদা এবং গুরুত্ব হাস করা হচ্ছে শিক্ষা ও সাহিত্য ক্ষেত্রে তাঁবেদার গোষ্ঠীর প্রতিপত্তি বাড়িয়ে। এই সংহতি অভিযানের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে কোন ফললাভের সুযোগ আমাদের নেই। কারণ এসবই পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার। কিন্তু জাতীয়তাবাদে উদ্দীপ্ত বাঙালী আজ হাতে অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে মুক্তি সংগ্রামের দুর্জয় অঙ্গীকারে। বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক বাংলার বাছাই করা বীর সন্তানেরা তাদের সঙ্গে নিজেদের বন্ধু-আত্মজনের রক্তস্নাত তৎখালীন ই-পি-আর, পুলিশ, আনসার বাহিনী আর মুক্তি- মাতাল বাঙালী তরুণ কিশোর ছাত্র এবং ছাত্রীরাও। রবীন্দ্রনাথ প্রার্থনা করেছিলেন “বাঙলার মাটি বাঙলার জল বাঙলার বায়ু বাঙলার ফল পুণ্য হউক।”- আজ এতদিনে শ্রেণী বর্ণ-গোত্র-ধর্ম নির্বিশেষে নিরীহ বাঙালী নরনারীর রক্তধৌত বাংলার মাটি মহাপুন্যাস্নাত হয়েছে। পাকিস্তানী হানাদার ঘাতকেরা ইতিহাসের একটি সহজ সত্য আবিষ্কার করতে পারেনি যে, সার্বিক মৃত্যু ছিটিয়ে একটি জাতিকে আর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার থেকে চিরকালের জন্যে বঞ্চিত রাখা যায় না। জাতীয়তাবাদ কোন একটা নির্ভরযোগ্য নীতি নয়। আমার মানসিক প্রস্তুতি আন্তর্জাতিকতাবাদ গ্রহণ করারই সপক্ষে। কিন্তু পাকিস্তানের কালে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিভিন্ন প্রসঙ্গে আমার বিভিন্ন কবিতায় বাঙালী