পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/২৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

218 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড অত্যন্ত গরীব এক কৃষক পরিবারের ছেলে ছিলাম আমি। তবু আমার মা-বাবার সাধ ছিলে, আশাআকাংক্ষা ছিলো-আমি বড়ো হবো, লেখাপড়া শিখে মানুষ হবো-সীমাহীন দারিদ্রের কশাঘাত থেকে পরিবারটিকে বাঁচিয়ে তুলবো। আমার মা-বাবার গোটা জীবন-তাদের আজীবন বাঁচার লড়াই আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিলো লেখাপড়া শিখতে। গাঁয়ের নওশের মাস্টারের পাঠশালে যেতাম। পাঠশালা বসতো সকালে, কারণ নওশের মাস্টারকেও আমার বাবার মতো মাঠে কাজ করতে হতো শুধু পেট চালানোর জন্যেই। দুপুরে আমার মাঠে কাটতো। আমাদের একটি গাই গরু ছিল। পাঠশালার পড়া সেরে আমি তাকে মাঠে চরাতে নিয়ে যেতাম। দুপুরে মাঠের মাঝখানের বটগাছের তলায় বসে যেন এক দারণ একাকীত্ব আমার ঘিরে ধরতো। একটা বাঁশির অভাব আমি বোধ করতাম। একদিন অনেক রাতে মায়ের কোলে ঘুমানোর সময় মাকে কথাটা বলেছিলাম। মা রাজী হয়েছিলেন, আমাদের গা থেকে দু’মাইল দূরে বৈশাখী মেলা বসলে আমাকে একটা তালপাতায় রাঙা বাঁশি কিনে দেয়া হবে। এরপর থেকে প্রতিদিন প্রতিটি মুহুর্তে আমার কল্পনার ভাসতে লাগলো তালপাতার একটা বাঁশি। মুহূর্ত দিন গুণতে গুণতে সত্যি সত্যিই সেই দিনটি ফিরে এলো । মা আমাকে দু’আনা পয়সা দিলো। সাতরাজার ধন মানিকের মতো ওই দু’আনা পয়সা হাতের মুঠোয় চেপে ধরে চঞ্চল এক হরিণশিশুর মতো আমি ছুটে যাচ্ছিলাম। পুকুরের পাড়ে বসেছিলেন ফকির দাদু। আশি বছরের এক সহায়-সম্বলহীন বৃদ্ধ। গাঁয়ের সব ছোটরা তাঁকে দাদু বলতো। আমাকে ওভাবে ছুটে যেতে দেখে তিনি আমায় ডাক দিলেনঃ কোথায় যাচ্ছো দাদুভাই। হাঁপাতে হাঁপাতে আমি বললামঃ আমি-আমি মেলায় যাচ্ছি- বাঁশি কিনতে। মা আমাকে দু’আনা পয়সা দিয়েছে। বৃদ্ধ আমার শেষের কথাগুলো শুনতে পেয়েছিলেন কিনা জানি না, মেলা থেকে ফেরার সময় বৃদ্ধকে ওই একই জায়গায় আমি দেখেছিলাম। তিনি অবশি সকাল-সন্ধ্যে ওই জায়গাতেই বসতেন। সন্ধ্যায় ক্লান্ত হয়ে আমি যখন বাড়ি ফিরছিলাম তখন বিকেলের হলুদ রোদ গাছের চূড়োয় চূড়োয়। বৃদ্ধ আমায় জিজ্ঞেস করলেনঃ কই দাদুভাই তোমার বাঁশি কই? আমি সহজভাবে বললামঃ কিনিনি তো বৃদ্ধ বললেনঃ তবে তুমি যে বললে বাঁশি কিনবে? বললামঃ সারাদিন মেলায় ঘুরে ঘুরে আমার খুব ক্ষুদে পেয়েছিলো, মুড়ি কিনে খেয়ে ফেলেছি। বৃদ্ধ অপলক দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে কয়েক মুহুর্ত ধরে তাকিয়ে ছিলেন, তারপর হঠাৎ উচ্ছাসের সঙ্গে বলে উঠেছিলেনঃ বেশ, বেশ, করেছো দাদুভাই! মুড়ি খেতে আমারও বেশ ভালো লাগে- এখন সব নতুন চালের মুড়ি তো, বেশি মিষ্টি লাগে- তাই না দাদুভাই। মিষ্টি আমার মোটেই লাগেনি। প্রচণ্ড ক্ষিদের সময় মুড়িগুলো গিয়েছিলাম মাত্র। মেলায় ঘুরে ঘুরে রকমারি মিষ্টি আর নানা ধরনের নানা স্বাদের খাবার দেখার পর ওই শুকনো মুড়িগুলো মিষ্টি লাগার কথাও নয়। তাছাড়া বৃদ্ধ যতোই উচ্ছাস আর হাসির সঙ্গে কথাগুলো বলুন কেন, আমার কাছে তা বিষন্ন মনে হয়েছিল। সন্ধ্যায় আমাদের বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে মাও আমার বাঁশি কেনার কথা জিজ্ঞেস করেছিলো। আমি একই উত্তর দিয়েছিলাম। মা দারুণ স্নেহের আবেগে বুকে টেনে ধরে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। কিন্তু কয়েক মুহুর্ত পরেই মুখ তুলে মায়ের মুখের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম। মায়ের দু'চোখে জল। পারলাম না- উঠোন থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলাম আমাদের ভিটের এক প্রান্তে একটা ডালভাঙ্গা সজনে গাছের তলায়। সেখানে দাঁড়িয়ে চারিদিকের অন্ধকারে হঠাৎ হঠাৎ জুলে ওঠা জোনাকীদের আলো আর আমার বিধবা আপার ধরানোর চুলোর অগ্নিশিখা দেখতে দেখতে আমিও কাঁদছিলাম। সেদিন আমাদের দাদুভাইয়ের কণ্ঠের সেই বেদনাভারাক্রান্তের বিষণ্ণতা, আমার মায়ের এই আবেগাকুলতা, চোখের জল, আমার কান্না- এসবের কোন অর্থ আমি খুঁজে পাইনি।