পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/২৭০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

246 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড স্বদেশ স্বকাল ২০ ডিসেম্বর, ১৯৭১ বাংলাদেশে পাকিস্তানের মৃত্যু হলো আনুষ্ঠানিকভাবে এবং সেই সাথে শেষ হলো শাসনের এবং শোষণের একটি কলংকজনক অধ্যায়। হাজার মাইল দূর থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা এক তুলনাহীন বেঈমানকে, যে ভাইয়ের মুখোশ পরে সিন্দাবাদের গল্পের সেই অসহ্য দৈত্যটার মত বাংলাদেশের মানুষের ঘাড়ের ওপর চেপে বসেছিল গত চব্বিশ বছর ধরে, অবশেষে আমরা উৎখাত করলাম বাংলাদেশের মাটি থেকে। স্বেচ্ছায় ঘাড় থেকে নামেনি লোভী দৈত্যটা বারবার প্রচণ্ডভাবে মার খেয়ে একটি পরাজিত আহত কুকুরের মত সে আত্মসমর্পণ করেছে প্রাণ বাঁচাবার নিতান্ত জৈবিক তাড়নায়। বাংলাদেশে পাকিস্তানের কবর রচিত হবার সাথে সাথে মৃত্যু হলো উগ্র সাম্প্রদায়িকতার, যে বিষ একদিন বাংলাদেশের মানুষের উপর উগড়ে দেবার চেষ্টা করেছিল পশ্চিম পাকিস্তানী প্রাসাদষড়যন্ত্রীরা। বিগত চব্বিশ বছর ধরে পাকিস্তানী প্রভুরা এই উৎকট বিষবৃক্ষটিকে বাংলাদেশের মাটিতে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছে। কারণ, নিরবচ্ছিন্ন শাসন এবং শোষণ চালিয়ে যাবার জন্যে প্রয়োজন ছিল বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা, একজন বাঙালীকে অন্য একজন বাঙালীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা। এর জন্যে আমদানী করার চেষ্টা চলেছিল সাম্প্রদায়িকতার, যা মানুষকে ঘৃণা করে, অবিশ্বাস করতে এবং অর্থহীন হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হতে প্ররোচিত করে। এই সচেতন উগ্র সাম্প্রদায়িকতার জন্ম দিয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানী প্রভুরা- এ কথা সত্যি, কিন্তু এই বিষবৃক্ষটির লালনে এবং পুষ্টিসাধনে নিরন্তর সহায়তা যুগিয়েছে একদল বাংলাদেশের ভাড়াটিয়া বুদ্ধিজীবীযারা সামান্য কিছু লাভের আশায় নিজেদের বিবেক, বুদ্ধি ইত্যাদি বিসর্জন দিয়ে পশ্চিমা প্ৰভুদের প্রতিটি নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে পদলেহী কুকুরের মত। সাম্প্রদায়িকভাবে বাংলাদেশের মাটিতে জিইয়ে রাখবার জন্যে এরা সব রকম ঘৃণ্য কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে- এমনকি বাঙালী সংস্কৃতিকে সমূলে বিনাশ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতেও এদের বিবেকে বাধেনি। এরাই প্রচেষ্টা চালিয়েছে, উর্দু হরফে বাংলার প্রচলনের, এরাই ফরমান দিয়েছে রবীন্দ্রনাথ বর্জনের, এরাই মুখর হয়েছে বাঙালী আচার-অনুষ্ঠান পালনের বিরুদ্ধে। সর্বস্তরে এই উৎকট ব্যাধিটিকে ছড়িয়ে দেবার জন্যে সমগ্র দেশব্যাপী গড়ে তুলেছে বিএনআর, পাকিস্তান কাউন্সিল ইত্যাদি মগজ ধোলাইয়ের প্রতিষ্ঠান। এরাই বিকৃত করে রচনা করেছে ইতিহাস, এমনকি সুকুমারমতি শিশুদের মনটিকে পর্যন্ত বিষিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে- সাম্প্রদায়িকতা প্রচার করে। এদের আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বাঙালীর বাঙালিত্ব, তার আচার অনুষ্ঠান, তার ভাষা, তার আজন্মের অন্তরঙ্গ সংস্কৃতি। পশ্চিমা প্ৰভুদের সুরে সুর মিলিয়ে এরাও গান ধরেছিলঃ বাঙালীয়ানা আসলে হিন্দুয়ানীরই নামান্তর মাত্র। বাংলা ভাষাটাই নাকি হিন্দুদের ভাষা- মায়ের ভাষা হওয়া সত্ত্বেও বাঙালী মুসলমানের তাতে কোন অধিকার নাই। অতএব একজন সাচ্চা পাকিস্তানী হতে হলে এইসব বাঙালীয়ানা সযত্নে পরিহার করতে হবে এবং তার বদলে গ্রহণ করতে হবে পশ্চিমা প্ৰভুদের প্রেরিত সেই ঘৃণ্য, ব্যাধিটিকে, যার নাম সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততা। বাংলাদেশে বাঙালী সংস্কৃতি চলবে না, তার বদলে বরণ করতে হবে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ধোলাই হয়ে আসা পাকিস্তানী তমদ্দুন নামক আজব বস্তুটিকে। এসব কুকীর্তির বিনিময়ে কুচক্রী প্ৰভুদের কাছ থেকে কিছুই যে ইনাম মেলেনি তা নয়। এই পাপের পথে পদচারণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে কুখ্যাত শিক্ষকটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ লাভ করেছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে ঘৃণ্য মীরজাফরটি পেয়েছে দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের রাষ্ট্ৰীয় পুরস্কার এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ। এবং একইভাবে লাভবান হয়েছে তাদের সমগোত্রীয় ভাড়াটিয়া বুদ্ধিজীবীরা। কিন্তু এই সমস্ত ঘৃণ্য দেশদ্রোহীদের চক্রান্ত কোদিনই বিভ্রান্ত