পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/২৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

247 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড করতে পারেনি বাংলাদেশের মানুষের মুক্তবুদ্ধিকে- ফেলে আসা কয়টি উজ্জ্বল গণআন্দোলন এবং আমাদের গৌরবময় স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি অধ্যায় এই মন্তব্যের সপক্ষে রায় দেবে। নগ্ন অর্থনৈতিক শোষণ যখন বাংলাদেশের মানুষকে নিক্ষেপ করেছে এক অকল্পনীয় দুঃসময়ের বিবরে, তাদের কাছে দিনের আলোর মত স্বচ্ছ হয়ে গেছে চক্রান্তের আসল রূপটি। মুক্ত বাংলাদেশে তাই আজ সাম্প্রদায়িকতার কোন ঠাই নেই। আপন ধর্মবিশ্বাসে অবিচল থেকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে দিতে রাজি নই। আমার সোনার বাংলাদেশে তাই আর সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু বলে কোন কথা নেই- প্রতিটি মানুষের আপন আপন ধর্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদা এবং স্বাধিকার নিয়ে বাঁচবার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। উগ্র সাম্প্রদায়িকতা মানুষের মুক্তবুদ্ধিকে কিভাবে আচ্ছন্ন করে, এ কথা আলোচনা করতে গিয়ে এই মুহুর্তে অনেক দিন আগে পড়া সুসাহিত্যিক শ্রী মনোজ বসুর একটি আশ্চর্য সুন্দর গল্পের কথা আমার মনে পড়ছে। দেশ বিভাগকালীন অর্থহীন সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততার পটভূমিতে লেখা গল্পটি। এক গ্রামে পাশাপাশি বাস করত দুটি পরিবার- একটি হিন্দু, অন্যটি মুসলমান। এই দুই পরিবারের সম্পর্ক ছিল নিবিড় সম্প্রীতির এবং অন্তরঙ্গতার। তারপর- এক সময় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের একটি ছোট্ট ঢেউ সেই সুদূর গ্রামটিতেও গিয়ে লাগল এবং ফাটল ধরল সম্পর্কের। একে অন্যকে অবিশ্বাস করতে আরম্ভ করল, সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করল। বন্ধ হয়ে গেল মেলামেশা পর্যন্ত। দু’বাড়ির দুটি ছোট ছেলেমেয়ে কিন্তু এতসব জানতো না। তাই বাপ-মা'র নিষেধ সত্ত্বেও তাদের লুকিয়ে মেলামেশা বন্ধ হয়নি। একদিন হিন্দু বাড়ির সেই ছোট্ট ছেলেটি মুসলমান বাড়ির মেয়েটিকে বলল, “জনিস মুসলমানরা হিন্দুদের দেখলেই কেটে ফেলছে।’ তুই কিছু জানিস না, মেয়েটি বলল। আসলে হিন্দুরাই মেরে ফেলছে মুসলমানদের। একটু নীরবতা। তারপর মেয়েটি বলল, আচ্ছা তুই হিন্দু দেখেছিস? ছেলেটি বলল, নাতো! তা তুই মুসলমান দেখেসনি? মেয়েটি উত্তর করল, না রে! দরকার নেই বাবা ওসব হিন্দু-মুসলমান দেখে। ছোট্ট ছেলেমেয়ে দুটি খুবই আশ্বস্ত বোধ করল এই ভেবে যে, ওদের কাছাকাছি কোন হিন্দু' বা “মুসলমান নেই। গল্পটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় কি হাস্যকর এই উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, যার নিরর্থকতা ছোট্ট দুটি ছেলেমেয়েও তাদের সহজাত বুদ্ধিতে বুঝতে পেরেছে। উগ্র ধর্মান্ধতা অনেক দেখেছি আমরা, বারবার ক্ষতবিক্ষত হয়েছি তার বিষাক্ত নখরে। তাই বাংলাদেশের পবিত্র মাটিতে এই কুৎসিৎ বিষবৃক্ষটিকে ঠাই দিতে আর প্রস্তুত নই আমরা। (অসিত রায় চৌধুরী রচিত)