পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/২৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

253 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড পাকিস্তানের ইতিহাসে এই প্রথম সারা পাকিস্তানের মানুষ দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হলো গণবিমুখ শাসকচক্রেকে উৎখাতের লড়াইয়ে। ১৯৬৯- এর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন পাকিস্তানের শাসকচক্রের ভিত নড়িয়ে দেয় এবং তারা বুঝতে পারে যে জনতার এই একতায় ফাটল না ধরাতে পারলে তাদের একচেটিয়া শোষণ আর গণবিমুখ শাসনব্যবস্থাকে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখা সম্ভবপর হবে না। জনতার মধ্যে ভাঙন ও বিরোধ সৃষ্টির সবচেয়ে সহজ পন্থা হচ্ছে সাম্প্রদায়িক কলহের জন্ম দেয়া-হিন্দু-মুসলমান বিরোধ, বাঙালী-অবাঙালী বিরোধ, পাঞ্জাবী-পাঠান বিরোধ, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে যখনই গদিচ্যুত হবার সম্ভবনা প্রকট হয়ে উঠছে, তখনই যে কোন একটি সাম্প্রদায়িক পদ্ধতি অবলম্বন করে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্তির পথে চালিয়ে, ১৯৬৯- এর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে ফাটল ধরাবার চেষ্টা করেও যখন শাসকচক্র ব্যর্থ হলো, তখন একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আইয়ুব খান সরে গিয়ে ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা তুলে দিলেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান চক্রান্তের পরিকল্পিত পথে ধীরে ধীরে এগোতে থাকলেন। মুখে বলতে লাগলেন প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। আসলে তাঁর পরিকাল্পনা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ছোট-বড় সকল রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে তিনি পৃথক-পৃথকভাবে মিলিত হতে লাগলেন- কখনো প্রকাশ্যে, কখনো গোপনে উদ্দেশ্য ছিলো পরস্পরের বিরুদ্ধে পরস্পরকে লাগিয়ে দেয়া। সকল দলের সঙ্গে সমানে তাল রেখে চলেছিলেন তিনি। নিজেকে সাধু-সজ্জন হিসেবে উপস্থিত করেছিলেন সবার কাছে। নির্বাচনের দিন তারিখ ঘনিয়ে আসতে লাগল। এমন সময় ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসের শুরুতে ভয়াবহ এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হলো পূর্ব বাংলার মানুষ। সর্বনাশা ঝড় আর সামুদ্রিক জলচ্ছাসে দশ লাক্ষ মানুষ মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে প্রাণ হারালো। পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ সহায়- সম্বলহীন হয়ে পড়ল। পৃথিবীতে এত বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর হয়নি। এই দুর্যোগের সময়ে হাজার হাজার বিদেশী সৈন্য , বিদেশী সাংবাদিক বিদেশী সাহায্যকারীতে ভরে গেল পূর্ব বাংলার ঝড় উপদ্রুত অঞ্চল। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকচক্রের একটি লোকও এলেন না এই অসহায় মানুষগুলোকে একটু সান্তনা জানাবার জন্যে। বাতাসে অনেক কথা শোনা যেতে লগল। নানা প্রশ্ন উঠল নানা মহল থেকে। ত্রাণ কাজের নাম করে বিদেশী সৈন্য কেন নামবে আমাদের মাটিতে? আমাদে সৈন্যরা বসে বসে করছে কি? এত বড় দুর্যোগ ঘটে গেল কিন্তু দেশের প্রেসিডেন্ট আর তার হেলিকপ্টারগুলো গেলো কোথায়? নানা গুজব ছড়াতে লাগল দ্রুত। জনৈক বিদেশী সাংবাদিক জানালেন, তোমাদের জন্য দুঃখ হয়। দশ লাক্ষ লোক তোমরা ঝড়ে হারিয়েছো। কিন্ত আরো দুঃখ আছে তোমাদের কপালে। আরো অনেক প্রাণ তোমাদের দিতে হবে শীঘ্রই। বিদেশী সাংবাদিকের এই উক্তি তখন থেকেই নানা আলোচনা, সমালোচনা, সন্দেহ এবং জল্পনা কল্পনার জন্ম দিয়েছিল পূর্ববাংলায়। অনেকের মনেই সন্দেহ জেগেছিল, আমরা কি কোনো বিশ্বরাজনীতির দাবা খেলার ছকের মধ্যে পড়ে আছি? নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে এলো। যথা সময়ে শান্তি পূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। পাকিস্তানের চব্বিশ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে সারা পাকিস্তান ব্যপী সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেলো পাকিস্তানের নাগরিকরা। নির্বাচনের ফলাফল বেরবার সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেলো পাকিস্তানের পাঁচটি প্রদেশের মধ্যে তিনটি প্রদেশে গণতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসন ও একচেটিয়া শোষণের অবসানকারী দুটি দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। দল দুটি হলো- আওয়ামী লীগ আর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি। আর প্রদেশ তিনটি হলো- পূর্ববাংলা, বেলুচিস্তান আর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ। বাকি দুটি প্রদেশ সিন্ধু ও পাঞ্জাবে জয়ী হলো জুলফিকার আলী ভুট্টোর দল পিপলস পার্টি। পিপলস পার্টির নির্বাচনী ইস্তাহারেও একচেটিয়া শোষনের অবসান ও সমাজতান্ত্রিক প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল।