পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/২৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

256 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড ইতিহাসের এক বিভীষিকাময় গণহত্যা শুরু হলো। ট্যাঙ্ক, মেশিনগান, মর্টার, বোমারু বিমান ব্যবহৃত হলো নিরস্ত্র মানুষকে মারার জন্যে। লক্ষ লক্ষ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করল তারা। কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, নারী, পুরুষ, দুগ্ধপোষ্য শিশু, ছাত্র, কেরানী, বুদ্ধিজীবী-কেউ বাদ গেল না তাদের এই নৃশংস বর্বরতার হাত থেকে। ইয়াহিয়া খানের হিংস্র বন্য সেনারা অসউইজ আর বুখেনওয়ালডের হত্যাকাণ্ডকেও স্নান করে দিল। মৃত্যুর বিভীষিকার মধ্যে অসহায় বাংলার মেহনতি মানুষ আর দুর্জয় মনোবল আর তার সাহস নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল মরণপণ প্রতিরোধ যুদ্ধে। বাংলার ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই-পি-আর, আনসার আর পুলিশ বাহিনী তাদের মা-বোনদের ইজ্জত রক্ষার জন্যে অস্ত্র তুলে নিল হাতে। আর অন্যদিকে, ইয়াহিয়া খানের বর্বর সেনারা গ্রামের পর গ্রাম জুলিয়ে দিয়ে পুরো দেশটাকে শ্মশানে পরিণত করতে লাগল। হিংসার এই উন্মত্তার মধ্যে বাংলাদেশের জনগণের নিজস্ব সরকার গঠন ছাড়া আর অন্য কোনো পথ রইল না। বাংলাদেশের জন-প্রতিনিধিরা তাই মুজিবনগরে সমবেত হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করলেন। পাকিস্তান এখন বাংলাদেশের মানুষের কাছে মৃত। পাকিস্তানের এই অপমৃত্যুর জন্যে বাংলাদেশের মানুষ দায়ী হয়। দায়ী পাকিস্তানের শাসকচক্র, যারা পাকিস্তানের সকল ভাষাভাষী অঞ্চলের মানুষের স্বাধিকারের প্রশ্নকে লক্ষ লক্ষ লাশের নীচে দাবিয়ে রাখতে চেয়েছে। পাকিস্তানের এই মৃত্যুর জন্যে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর দলও দায়ী নয়। দায়ী লিয়াকত আলী খান থেকে শুরু করে গোলাম মোহাম্মদ, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, ইস্কান্দার মীর্জা, খাজা শাহাবুদ্দিন, খান আলী ভুট্টো প্রভৃতি গুটিকয়েক ক্ষমতালি সু কায়েমী স্বার্থবাদী আমলা-মুৎসুদ্দি, সামন্তপ্রভু, ধনপতি, ব্যক্তিগত জমিদারী হিসেবে ব্যবহার করে এসেছে। বাংলাদেশ এখন প্রতিটি বাঙালীর প্রাণ। বাংলাদেশে তারা পাকিস্তানের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতে দেবে না। সেখানে তারা গড়ে তুলবে এক শোষণহীন সমাজব্যবস্থা। সেখানে মানুষ প্রাণ ভরে হাসতে পারবে, সুখেশান্তিতে থাকতে পারবে। ংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধভাবে লড়ছে। লড়ছে সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত এক পেশাদার বাহিনীর সঙ্গে। লড়ছে মৃত্যুকে তুচ্ছ করে জীবনকে অর্জন করার জন্য। বাংলার মানুষের এইমুক্তির লড়াই পশ্চিম পাকিস্তানের নিপীড়িত অঞ্চলের মেহনতি মানুষকেও শোষণমুক্ত হবার প্রেরণা যোগাবে। (জহির রায়হান রচিত)