পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/২৮৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

26| বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড শোকাহতা মা নাকি তাকে বলেছিলেনঃ বাবা তুই যদি আমার সন্তান হোস, তাহলে এই ঘৃণ্য অপরাধের যোগ্য প্রতিশোধ তুই নিবি৷ যা, এক্ষুনি বের হয়ে পড়- মা-বোনদের অপমানের প্রতিশোধ তোকে নিতেই হবে। মায়ের দোয়া মাথায় নিয়ে সেই সে তরুণ ছাত্রটি বেরিয়ে এসেছে, আর ঘরে ফেরেনি। এরপর মুক্তিবাহিনীতে ট্রেনিং নিয়ে শত্রর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে চলেছে। ছোট ভাইবোনের হত্যার প্রতিশোধ সে নিয়েছে। নিজের হাতে হত্যা করেছে পাঁচজন খান সেনাকে। তবু তার শান্তি নেই, বিশ্রাম নেই। যেদিন বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ মুক্ত হবে, বাংলাদেশের শহরে-বন্দরে-গ্রামে উড়বে স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় পতাকা, সেদিনই হবে তার সত্যিকারের প্রতিশোধ নেওয়া। মাতৃভূমির স্বাধীনতাযুদ্ধের সেই বীর সৈনিকের নিষ্ঠা ও অবিচলতার প্রমাণ তার কথা থেকেই। অমিততেজ বাঙালী তরুণ আমাকে বললঃ দেখুন, যারা আমার বোনের ইজ্জত নষ্ট করেছিলো, আমিও পেয়েছিলাম তাদের মা-বোনের ইজ্জত নষ্ট করার সুযোগ; কিন্তু তা আমি করিনি। তা আমি করতে পারি না। সহকর্মীদেরও এমন অপকর্ম থেকে নিবৃত করেছিলাম- কেননা আমরা যে পাশবিকতার বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করছি। ওরা পশু, ওরাই পারে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় মানবিক মূল্যবোধকে পদদলিত করতে- আমরা তা করতে পারি না। আমরা একটা বিস্তৃত মাঠের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম। মাঠের এখানে সেখানে লোকজন কাজ করছে। কেউ ধান কাটছে, কেউ ঘাস তুলছে ক্ষেত থেকে। একটা পাটক্ষেতের আড়ালে কজন ক্ষেতচাষী ধানখেত থেকে ঘাস তুলছে। তাদের দিকে আমার দৃষ্টি ফিরিয়ে তরুণ আমাকে বললো, ওরা আমাদেরই লোক। আরো বললোবাংলাদেশের মুক্তিসেনারা এমনি করে ছড়িয়ে আছে গ্রাম-গ্রামান্তরে বাংলার মাঠে-ঘাটে সর্বত্র। ঐ যে সামনে নদীটা দেখছেন তার ওপারেই রয়েছে একটা বাজার। বাজারে আগে পাকিস্তানী সৈন্যের ঘাটি ছিলো। তাদের সাথে মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে বেশীরভাগ খানসেনা মারা পড়েছে। আর যারা বেঁচে ছিলো তারা সবাই প্রাণ নিয়ে কোনমতে পালিয়েছে। তারপর বহুদিন এদিক আর ওরা আসেনি। কিন্তু গতকাল নাকি একটা দল এসেছিলো। শুনেছি আজো আবার আসতে পারে। তাই আমাদের মুক্তিসেনারা পশুদের যোগ্য শিক্ষা দেওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছে। বিদায় নিলো। অতপর তীরে গিয়ে আমি নেমে পড়লাম। পাটনীও আমার পেছনে পেছনে নেমে পড়লো। সে আমাকে নির্দিষ্ট একটা রাস্তা এড়িয়ে যেতে বললো। আমি যখন সেই বাজারের উপর দিয়ে যাচ্ছিলাম, আনন্দে তখন আমার বুকটা ভরে উঠলো। সেখানে সবগুলো দোকানেই উড়ছিলো স্বাধীন বাংলার পতাকা নিজের মনেই খানিক দাঁড়িয়ে গেলাম। সেখানে শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হয়ে এলো। বললাম : সালাম, আমার স্বাধীন বাংলার বিজয় পতাকা, তোমাকে সালাম। আরো মাইল তিনেক এগিয়ে গেলাম। চোখের সামনে বর্বর পাকিস্তানী সেনাদের পাশবিকতার চিহ্ন। চারদিক ধ্বংসের ছাপ লেগে আছে। সবকিছু লণ্ডভণ্ড, আগুনে জুলিয়েছে গ্রামের পর গ্রাম লণ্ডভণ্ড করেছে কতো সুখের সংসার। খুব পিপাসা পেয়েছিলো। বারান্দায় এক বৃদ্ধকে দেখে এগিয়ে গেলাম। বললাম, বুড়িমা পানি খাবো। বৃদ্ধার বয়স ৭০/৭৫ হবে। একটা ছেলেকে পানি আনতে বলে তার দুঃখের কথা শুরু করলেন। বৃদ্ধা জিজ্ঞাসা করলেন আমি কোথা থেকে এসেছি। বলাম মুজিবনগর থেকে। বাড়ি যাবো। বাড়ি যাবো এ কথাটা শুনেই বৃদ্ধ আত্ক উঠলেন, বললেন- বাড়ি যেয়োনা, পাঞ্জাবীরা মেরে ফেলবে, ওরা মানুষ নয়, ওরা পশু। দেখছো না, আমার ঘর খালি। আমার সোনার ছেলেদের ওরা হত্যা করেছে। আমার আর কেউ নেই বাবা। তবু আমি কেনো যে বেঁচে রইলাম। বলতে বলতে বৃদ্ধা আকুল কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।