পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/২৮৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

262 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড বললাম-বুড়িমা কাঁদবেন না। আপনার ছেলে গেছে, আমরা রয়েছি তো আপনার সন্তান- আপনার আরো পানি খেয়ে উঠতে যাচ্ছিলাম, বৃদ্ধা বললেন- আচ্ছা বাবা বল তো, ঐ যে আমরা ভোট দিয়েছিলাম, সেই মুজিবর ভালো আছে তো? সে বেঁচে থাকলে এর শোধ নেবেই। দেখলাম গ্রামের সাধারণ বৃদ্ধাও বঙ্গবন্ধুর খবর রাখে- তার হৃদয়ে রয়েছে তার জন্যে অফুরন্ত দরদ। আরো অবাক হলাম এ ভেবে, যে দেশে এমন বৃদ্ধা রয়েছে সে দেশের ছেলেরা বীর সৈনিক না হয়েই পারে না। এরপর যেখানে গেলাম সেটি যশোরের প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা এবং জাতীয় পরিষদ সদস্য জনাব মশিউর রহমানের নির্বচনী এলাকা। চারদিকে থমথমে ভাব। কোথাও কোনো মানুষ দেখা গোল না। এই জনশূন্য পথে চলতে চলতে হঠাৎ রাস্তার উপর একটি লোকের সাথে দেখা। ২৭/২৮ বছরের লোকটির মুখে দাড়ি। পরনে পাঞ্জাবি। দেখে স্বাভাবিকভাবেই মনে হবে লোকটি সম্ভবত জামাতপন্থী কেউ হবেন। দু’জন পাশাপাশি চলছি, কারো মুখে কোনো কথা নেই। আরো কিছুটা পথ এগিয়ে গিয়ে নিতান্ত কৌতুহল ও উদ্বেগ বশেই জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা ভাই, মশিউর রহমান সাহেবের খবর কি?” প্রশ্ন করেই নিজের মনেই শংকিত হলাম কি জানি কি হয়। কিন্তু প্রশ্ন শুনে লোকটি আমার দিকে এমন বিমূঢ় বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন যে তাকে দেখে মনে হবে তিনি যেন কোন ভাবনার সাগরে ডুবে আছেন। সারা চোখ-মুখে তার উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠলো। হয়তো এক্ষুনি দু'চোখ বেয়ে নামবে অশ্রুর বন্যা। ভরসা পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি এমন বিচলিত হলেন কেনো? তাকিয়ে দেখি পাঞ্জাবি পরা সেই অপরিচিত লোকটির চোখ বেয়ে তখন অশ্রু পড়াতে শুরু করেছে। তারই মধ্যে আমাকে বললেনঃ দেখুন, শেখ সাহেব কিংবা মশিউর রহমানের কথা তো কেউ এমন প্রকাশ্যে বলাবলি করতে সাহস করে না। তাই আপনার কথা শুনে আমার অনেক কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। আপনি বোধ হয় এ এলাকায় নতুন এসেছেন? পরে আলাপে জানতে পারলাম লোকটি স্থানীয় একটি প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জন্যে প্রাণপণ খেটেছেন। মাইল খানেক একসাথে গিয়ে তিনি ভিন্ন রাস্তায় চলে গেলেন। যাওয়ার আগে আমাকে সাবধান করে দিয়ে গেলেন যেন প্রকাশ্যে এমন কথা আর কাউকে আমি জিজ্ঞেস না করি। মশিউর রহমানের পৈত্রিক গ্রাম সিংহঝুলি। সেখানে গড়ে উঠেছে ছোটখাটো একটা উপশহর। তার উপর দিয়ে চলে গেছে যশোর-চৌগাছা সি এণ্ড বি রোড। রোড থেকে মাত্র এক মাইল দূরে আছি। সি এণ্ড বি রোড পার হবার জন্যে এগিয়ে যাচ্ছি-হঠাৎ পাশের বাড়ি থেকে দৌড়ে এলো একটি লোক। বললো, বসে পড়ুন সাহেব, বসে পড়ুন। ঐ যে মিলিটারীর গাড়ি আসছে যশোরের দিক থেকে। লোকটি একরকম জোর করে আমাকে রাস্তার একপাশে বসিয়ে দেয়। দেখতে দেখতে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য বোঝাই তিনখানা গাড়ি এসে দাঁড়ালো বাজারের উপর। গাড়ির গতি থামলো মাত্র মিনিট খানেকের জন্যে। চারদিকে একবার নজর করে ভোঁ করে চৌগাছার দিকে ছুটে চললো তারা। লোকটির কাছেই শুনলাম, ঐ অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর হাতে বারবার প্রচণ্ড মার খেয়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা আজকাল এদিকে বড়ো একটা এগুতে সাহস করে না। যদিওবা আসে একদণ্ড অপেক্ষা করার ভরসা পায় না। মিলিটারীর গাড়িগুলো চলে যাওয়ার সংগে সংগে আমি তাড়াতাড়ি সি এণ্ড বি সড়ক পাড়ি দিলাম। যাবার সময় দু’পাশে তাকিয়ে দেখলাম ধ্বংসস্তুপের সীমাহীন চিহ্নরাশি। সারা বাজারের প্রায় ৯০ ভাগ বাড়িই হার্মাদ