পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/২৯২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

268 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড খুশিতে লাফিয়ে উঠলাম। জন্তু বধ করার সময় হয়ে গেছে। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমরা যাত্রা আরম্ভ করলামকখনো হামাগুড়ি দিয়ে, কখনো পায়ের আঙ্গুলে ভর দিয়ে নিঃশব্দে, কখনো খর পায়ে। শত্রক্যাম্পের থেকে একটু দূরে আমাদের নির্দিষ্ট স্থানে এসে আমরা A.B.C পদ্ধতিতে ভাগ হয়ে দাঁড়ালাম। A ও B দুই দল LM-G, H-M-G, S-M-G সাধারণ রাইফেল নিয়ে দাঁড়াল দুই টিলার আড়ালে। এখান থেকে শক্রক্যাম্প মাত্র চারশ গজের মত দূরত্ব। আর C দলের দুইজন রকেট লাঞ্চার নিয়ে আমাদের উল্টো দিকে শত্রক্যাম্পকে আমাদের উভয়ের মধ্যে রেখে প্রস্তুত হয়ে রইল। ঠিক সাড়ে এগারটা বাজতে সে দল বাদে আমাদের সবার অস্ত্র গর্জন করে উঠল। হঠাৎ-আক্রমণে শত্রসৈন্যগুলি কিছু বুঝতে না পেরে ক্যাম্পের ভিতরেই চুপ করে বসে রইল। বাইরে যে কয়জন ক্যাম্প গার্ড দেয়ার জন্য ছিল, তারা, সে আবছা আলোতেও দেখলাম মৃত্যুযন্ত্রণায় দাপড়াচ্ছে। ক্যাম্পের ভিতরের সৈন্যগুলোর কোন সাড়া-শব্দ না পাওয়াতে আমরা বুঝতে পারলাম তারা কিছু একটা ফন্দী বের করার চেষ্টা চালাচ্ছে। চারিদিকে নীরব। আমাদের অস্ত্রগুলিও তখন নীরব। কারণ আমাদের উপরে কড়া নির্দেশ অযথা গুলি নষ্ট করা যাবে না। হঠাৎ ওদিকে যারা বসে ছিল তাদের রকেট লাঞ্চার গর্জন করে উঠল ও একসঙ্গে বহু মর্মান্তিক আৰ্তরব সেই ভয়াল নীরবতাকে খান খান করে তুলল, আর সঙ্গে সঙ্গে তারা কিছুক্ষণ নীরব থেকে এই ফন্দি বের করেছিল যে যেহেতু আমরা সামনে দিয়ে আক্রমণ করছি, তাই তারা নিঃশব্দে ক্যাম্পের পিছন দিক দিয়ে আমাদের অস্ত্রের রেঞ্জের বাইরে চলে যাবে ও সেখান থেকে দূরপাল্লার রকেট ও মর্টারের সাহায্যে আমাদের নিশ্চিহ্ন করে দেবে। কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি যে তারা যেদিকে পিছন ফিরে সরে আমাদের আক্রমণের চেষ্টা করছে সেখানেই আমাদের দলের দুজন রকেট লাঞ্চার নিয়ে বসে আছে। তাই যখন তারা আমাদের সেই দুজনের রকেট লাঞ্চারের রেঞ্জে এসে পড়ল অমনি আমাদের পক্ষের রকেট লাঞ্চার গর্জন করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে আমরা এগারজন ছত্রভঙ্গ ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় শত্রসৈন্যের উপর এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের কোণঠাসা করে আনলাম। অল্পক্ষণ পরেই আমাদের কমাণ্ডারের আদেশে শত্রসৈন্যরা অস্ত্র ফেলে আত্মসমর্পণ করল। গুণে দেখলাম চল্লিশজন। মৃতদের সংখ্যা ২১০ জন হয় নাকি আর গুনিনি বলে একটু হেসে আমার দিকে তাকাল। কিন্তু লক্ষ করে দেখলাম সেই হাসিতে কী এক বিষন্নতার ছাপ, যেন একটু ভিজে ভিজে। পরে একটু থেমে আবার বলল, “না গুণে ভালই করেছিলাম। কারণ মৃতের সংখ্যা একটু বেশীই ছিল। আমার দুজন বন্ধুও কাল শহীদ হয়েছে। তার ছলছলে চোখ দুটো দেখে আমার চোখ ভিজে আসলো। দেখলাম চারদিকে গোধূলি থমথমে হয়ে উঠেছে। তাকে আর সান্তনা দেয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম না। কাল প্রথম সূর্যোদয়ে সে আবার হয়ত ঝাঁপিয়ে পড়বে কোন রণাঙ্গনে। জিঘাংসার মদমত্ততায়ই হয়ত তার কেটে যাবে প্রতিটি সূর্যোদয়, প্রতিটি সূর্যস্ত। এই সময়টুকু যদি দিনান্তের বিধুবতায় সে আত্মবিশ্লেষণে বসে প্রিয়জনের বিয়োগব্যথায় তার চোখ ভরে আসে তবে মন্দ কী। (লেখকের নাম জানা যায়নি) দুর্জয় বাংলা ১২ নভেম্বর, ১৯৭১ ংলা চিরদুর্জয়-চির দুঃসাহসী তার দূরন্ত সন্তান। বাংলাদেশের গা বেয়ে ঝরছে রক্ত আর রক্ত, বাংলা মা-বোনের বুকে দুঃসহ কান্না আর কান্না। রক্তের বদলে রক্ত নিয়ে, মার অশ্রুজল মুছিয়ে দিয়ে লাঞ্ছনা ঘুচিয়ে দিতে বাংলার দূরন্ত দুলাল আজ বদ্ধমুষ্টি। কন্টকপথে বিরামহীন যাত্রায় শ্রান্তিহীন ক্লান্তিহীন তার ব্ৰত। শপথের