পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/৩০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

280 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড টিক্কা বিনা দ্বিধায় চট করে উত্তর দিয়েছিল, হুজুর ৭২ ঘণ্টা নয়, বলুন ২৪ ঘণ্টার ভেতরে আমি বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারব। শুধু দশ-বিশ লাখ বাঙ্গালীর রক্তের প্রয়োজন। এই উত্তরে সন্তুষ্ট হয়ে নাট্যকার ঘাতক ইয়াহিয়া আহাম্মকের স্বর্গ ইসলামাবাদ চলে যায়। পেছনে পড়ে থাকে সেই রক্তাক্ত নাটকের মঞ্চ বাংলাদেশ। ২৫শে মার্চের সেই ভয়াল রাতে নরঘাতক টিক্কা তার সশস্ত্র বর্বর বাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল নিরস্ত্র, নিরীহ ংলাদেশের মানুষের উপর। কামানের কুটিল গর্জনের সঙ্গে সঙ্গে ‘জয়বাংলা ধ্বনি আরও প্রচণ্ড রূপ নিয়ে ছড়িয়ে পড়ল বাংলার আকাশে-বাতাসে। টিক্কা খান এতে হতভম্ব হয়ে ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, এদেরকে নির্বাচারে হত্যা করার আদেশ দিল। পশ্চিম পাকিস্তানী বর্বর পশুরা দিনের পর দিন, রাতের পর রাত সমগ্র বাংলা জুড়ে চালাল হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ। গ্রামের পর গ্রাম তারা পুড়িয়ে দিল। বাংলার মাটিতে শুধু রক্ত আর রক্ত। একদিকে এইসব অত্যাচার অন্যদিকে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের শক্তি ও মনোবল দিন দিন বেড়েই চলল। বাংলার জনতা এক হয়ে একটা ইস্পাতের দেয়াল হয়ে গেল। রক্তলোলুপ হায়েনারা জানত না এরা বাংলার সন্তান, এরা সুন্দরবনের ভয়ঙ্কর বাঘের সাথে খেলে, প্রচণ্ড ঝড়ের সাথে পাঞ্জা লড়ে এবং মৃত্যুর চোখের উপর চোখ রেখে হাসে। গত ২৫শে মার্চের পরে টিক্কা খাঁর ২৪ ঘণ্টা- ঘণ্টা থেকে দিনে, দিন থেকে মাসে অতিক্রম করল। এখন স্বাধীনতা সংগ্রামের ৫ মাস। অর্থাৎ শত্রকবলিত বেতার থেকে প্রত্যহ তারা প্রচারণা চালাচ্ছে অবস্থা স্বাভাবিক তালা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ, কারখানার চাকা নিস্তব্ধ, মুক্তিবাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে বর্বর সৈন্যরা পালাবার পথ খুঁজছে, সত্তরজন সামরিক পদস্থ অফিসার প্রাণভয়ে আকাশ পথে পাড়ি জমিয়েছে। এইসব অফিসাররা তো আকাশপথে পাড়ি জমাবেই, বিপদ আসবে শুধু সাধারণ সৈন্যদের উপর। কেনই বা আসবে না? তাদেরকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়াই তো শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশ্য। সামরিক পদস্থ কোন অফিসার যুদ্ধে মারা গেলে তাদের মৃতদেহ কাঠের তৈরী কফিনে ভরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু সাধারণ সৈন্য মারা গেলে তাদেরকে বাংলাদেশের মাটিতে মাটিচাপা দিয়ে দায়সারা কাজ সারে। এটাই তো ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ। মিথ্যের সম্রাট ইয়াহিয়া খান ইরানে গিয়ে বলেছে, হিন্দুদের ভোটে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়ী হয়েছে। চমৎকার! মিথ্যার সম্রাট চমৎকার। তোমার ওষ্ঠদ্বয়ই শুধু চওড়া নয়, মিথ্যে বলায় তোমার জিভের দৌরাত্ম্যও অসীম। নিজের ঘৃণিত কার্যকলাপকে ঢেকে ফেলার জন্য আর কত মিথ্যে তুমি বলবে? শোন এহিয়া খাঁ, কান খুলে শোন, বাংলাদেশ স্বাধীন এবং এটা ধ্রুবতারার মত জীবন্ত সত্য। তোমাদের তথাকথিত পাকিস্তান মৃত। তার গলিত শবদেহকে সতুর কবরস্থ কর, নইলে পচন ধরা দেহের দুর্গন্ধ বাতাস বিষাক্ত করে তুলবে। মারাত্মক বীজাণু ছড়াবে বাতাসে বাতাসে। ইরানের সেই নোংরা বিবৃতিতে তুমি আরও বলেছ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তুমি শাস্তি দেবে। সাড়ে সাত কোটি মানুষের হৃদয় যার স্পন্দনে স্পন্দিত তাকে তুমি শাস্তি দেবে কি করে? শেখ মুজিব শুধু একজন ব্যক্তির নাম নয়, তার ব্যক্তিত্ব সমস্ত বাঙ্গালীর জন্য একটা আলোকস্তম্ভ, যে আলো পথনির্দেশ করবে একটা শোষণহীন জাতি প্রতিষ্ঠা করার জন্য। জেনে রেখো, আমরা যারা বাঙ্গালী তারা তোমাদের মতো শোষকদের এ দেশের মাটি থেকে নিশ্চিহ্ন করব। বাংলাদেশে-নব ইতিহাস সূচীত হবে, বাংলার আকাশ-বাতাসকে রবীন্দ্র-নজরুলের সঙ্গীত মুখরিত করে তুলবে। বিশ্বের সে নাম তোর। নরঘাতক হায়েনা ইয়াহিয়া, সে নাম তোর। (উর্দুতে মূল রচনা : জাহিদ সিদ্দিকী। অনুবাদ : আশরাফুল আলম)