পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/৩২৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

299 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড এক রণাঙ্গন থেকে অন্য রণাঙ্গনে। শিগগির বাংলাদেশ শত্রমুক্ত হবে, রফিকের দৃপ্ত ঘোষণা ভোর বেলাকার এক মিষ্টি স্বপ্লের আমেজ বয়ে আনে যেনবা। বেলা একটু বাড়তে দূর থেকে অবিরত এক যান্ত্রিক আওয়াজ স্পষ্টতর হয়ে ওঠে। লঞ্চের শব্দ অথবা কোন ষ্টীমারের প্রত্যাশায় ব্যগ্র গ্রামবাসীরা ভাবে। অনেকগুলো জিজ্ঞাসা পাক খায়ঃ যুদ্ধ কি শেষ হয়ে গেল তবে? হেরে গেছে খান সেনাদের দল? সেই শুভ ঘোষণা করতে আসছে বিজয়ী মুক্তিসেনারা? দুপুরের দিকে তারা এল এবং ঝাঁপিয়ে পড়ল ঘুমিয়ে থাকা পাখির মত অসহায় গ্রামটির ওপর। গানবোট থেকে দূরপাল্লার কামানের শব্দ জেগে উঠতেই আগন্তকের পরিচয় গোপন থাকেনি। গ্রামবাসী প্রথমে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছে। এ রকম একটি ভয়াবহ সম্ভাবনার কথা ওদের কল্পনাতেও অনুপস্থিত ছিল। এখন, এই নির্দয় দুপুরে, অকস্মাৎ তাকে শরীরী হয়ে উঠতে দেখে বৃষ্টির মত আতঙ্ক নামে এবং তা গড়িয়ে গড়িয়ে যায় গ্রামের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। গানবোটের কামানের শব্দ শুনেই দৌড়ে বাড়ি ফিরেছে জীবন। ওদের বাঁচাতে হবে- আমার বৃদ্ধা মা, স্ত্রী আর সন্তানকে। এই একটিমাত্র চিন্তায় সে একাগ্র এখন। দাওয়ায় বসে মা চীৎকার করে কাঁদছে, সরমার মুখ মৃতের মত ফ্যাকাসে, ছোট্ট বাবু অবাক হয়ে চেয়ে আছে- বাড়িতে পা দিতে তার সামনের দৃশ্যপটটি ছিল এই রকম। -চল, পালাতি হবে। মিলিটারী। কথা নয়, যেন কাঁদছে জীবন। -না মা, কিছছু নিতে হবে না। খালি হাতে চল। শিগগির। মা-বউ-ছেলেকে নিয়ে দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল জীবন। এখন, এই অভাবনীয় সংকটকালে, মৃত্যু যখন একটু ওপাশে ছা করে দাঁড়িয়ে, একটি নিশ্চিন্ত নির্ভাবনার আশ্রয়ের বড় প্রয়োজন। অথচ সেই নিশ্চিন্ততার আশ্রয় ওদের জোটেনি। রাস্তার মোড়ে সৈন্যের পোশাক পরে মৃত্যু ওদের অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে বসে ছিল। যমদূতগুলোর মুখোমুখি হতে আর্ত চিৎকার করে উঠেছে মা, গলা ছেড়ে কেদে উঠেছে সরমা, আর সেই সাথে ওদের হাতের মেশিনগানগুলো সক্রিয় হয়ে উঠেছে। চোখের সামনে লুটিয়ে পড়েছে মা, সরমা আর বাবু অথচ, কি আশ্চর্য, জীবনের চুল ছুয়ে বেরিয়ে যায় এক ঝাঁক গুলি এবং সেই সাথে রাস্তার পাশের আগাছা ভর্তি খানার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায়। দ্রুত ঘন ঝোপের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেলে শুনতে পেল বাবুর গোঙানি, ভারী ভারী বুটের আওয়াজ, বিজাতীয় ভাষার বীভৎস উল্লাসধ্বনি, সহসা কোন নারীকণ্ঠের আর্তনাদ উচ্চগ্রামে উঠে হারিয়ে যায় নিঃশব্দে। গুলির শব্দ থেমে যেতে এবং বুটের আওয়াজ ক্রমশ অপসৃয়মান মনে হতে, হামাগুড়ি দিয়ে বাইরে এসেছে জীবন রাস্তায় তার চোখের সামনে পাশাপাশি এলোমেলো শুয়ে তার জননী, তার জায়া, তার একমাত্র সন্তান, ওরা মরে গেছেএই নির্মম সত্যটি উপলব্ধির পরও চোখে জল এল না তার। অনেকক্ষণ বিরতির পর আবার খুব কাছাকাছি শোনা গেল গুলির আওয়াজ এবং আর্তচীৎকার। জীবন আর দেরী করেনি। ঝোপের মধ্যে গা-ঢাকা দিয়ে আবার মড়ার মত পড়ে রয়েছে। এই মৃত্যুপুরী থেকে, এই নরককুণ্ড থেকে আমি পালিয়ে যেতে চাই, তার লুপ্তপ্রায় চেতনায় তখন একটিমাত্র সিদ্ধান্ত।