পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/৩২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

302 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড উপর। সত্যিই, কি অন্যায় গোটা দেশটাকে ওরা একেবারে ছারখার করে দিল। এতো সুন্দর সাজানো শহর, মানুষজন, বাড়িগাড়ি, সব যেন কোথায় হারিয়ে গেল। কলকাকলিতে ভরা এতো বড়ো শহরটা, এখন যেন মৃতের শহর। কোথাও প্রাণের কোন কিছু নাই। পথেঘাটে কুকুরেরা লুটোপুটি করে খাচ্ছে মানুষের গলিত অর্ধগলিত শবদেহগুলি। এসব কথা ভাবতে ভাবতে আচম্বিতে তার মনে পড়লো গোলাপজানের কথা, তার মুখে শোনা আজ সকালের ঘটনাটা। আৎকে উঠলো সে। অজান্তেই ক্ষিপ্ৰ পদক্ষেপে সে হাঁটতে শুরু করলো বাড়ির দিকে। তার সাজানো সংসার আজো যেখানে অন্ধ স্যাঁতসেঁতে বস্তিবাড়িতে মোটামুটি সন্ত্রমের সাথেই টিকে আছে- গতকাল পর্যন্ত যেখানে শকুনীর দৃষ্টি পড়েনি- এতোক্ষণ সেখানে যে কি তাণ্ডবলীলা চলেছে কে জানে! আচ্ছা, মিলিটারীরা কি গোলাপজানকে ধরে নিয়ে গেছে? তাই যদি হয়- সলিম, তার বড়ো ছেলেটা, সে কি করছে? নাকি সংগীনের এক খোঁচায় তাকে....না, আর সে ভাবতে পারে না তা তিন মাসের কোলের বাচ্চাটার কথা। ভয়ে-উত্তেজনায় সে হাঁটতে থাকে, তার পা যেন আর উঠছে না মাটি থেকে। ক্লান্তিতে ভেঙ্গে সে বসে পড়লো রাস্তার পাশের বাবলা গাছটার নীচে, ঘাড় হতে তার ফেরীর বোঝাটা নামিয়ে। এক সময় তার মনে হলো আর বাড়ি গিয়ে কোন লাভ নাই, এতোক্ষণে সব শেষ। এখন বাড়ি গিয়ে যে দৃশ্য সে দেখবে, তা সে দেখতে চায় না। তা সে সহ্য করতে পারবে না। নাঃ, সে সে যাবেই না আর ওদিকে। বরং বরং সে কামালের সাথে দেখা করবে। উকিলপাড়ার চৌধুরীদের বড়ো ছেলে কামাল, তাদের কামাল ভাই। কামালদের বাড়িটা যেখানে ছিল, সেখানে তখন ইটসুরকির একটা বিরাট ধ্বংসস্তুপ পাকসেনাবাহিনীর বাহাদুরীর সাক্ষ্য হয়ে জমে আছে। যখন এ ঘটনা ঘটে তখন কামাল বাড়িতে ছিল না। যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্য হতে কামালের ছোটবোন আই-এ ক্লাশে পড়া কুমকুমকে ওরা শুধু জ্যান্ত ধরে নিয়ে গেছে। আর সবাইকে......যাকগে, এখন সেকথা ভেবে তার কি লাভ। কামাল কোথায় আছে তা সে জানে। বোঝাটা ঘাড়ে নিয়ে সেদিকে পা চালালো কলিম। এরপর-বিকেলের কিছু আগে কলিমুদিকে দেখা গেল, দুই ফুট চওড়া গ্রেটার রোডে। কোর্ট হতে মাইল দু’য়েক যে রাস্তার দিকে এগিয়ে গেলে হাতের ডাকদিকে চোখে পড়ে তীর চিহ্ন দেওয়া একটা কালো tržRERE, EKrašir: Iz sir: Gratt Sector Headquarter-B Prohibited Area- слfazi i a লেখা অবশ্য সে পড়তে পারে না, তবে একথা সে জানে ওখানে অনেক মিলিটারী থাকে। এই ভরভেলায় ওই রাস্তায় কলিম কেন যে বোঝাটা নিয়ে চলছে, তা অবশ্য বোঝা যাচ্ছে না। রাস্তার দু’পাশে যে সমস্ত বড়িঘর, সেগুলো জনশূন্যই, তবু দেখা গেল, দু’পাশের বাড়িগুলোর দিকে চাইতে চাইতে আর হাকতে হকতে কলিমুদ্দিন সে রাস্তা বেয়ে এগিয়ে আসছে। ধীরে ধীরে এসে পৌঁছল সে কাষ্ঠফলকের সামনে। ওখান হতে হাসাহাসি করছে। ওদের দেখেই কলিমুদ্দিন একটা লম্বা-চওড়া সালাম ঠুকে দিল, কোন জবাব এলো না। তাজ্জব বনে গেল। মিলিটারীগুলো। যেখানে ওদের দেখলেই সবাই পালায়, সেখানে এ ব্যাটা নিঃসংশয়মুখে ওদের সামনে দিয়ে শুধু যাচ্ছেই না, সালাম ও দিচ্ছে। একজন মিলিটারী ওকে ধমক দিয়ে উঠল- ‘আবে ভাগ, ইহা তেরা হাণ্ডি কোন খরিদেগা?- ‘অহনই যাইত্যাছি সাব, খুব পেরেসান অইছি, পসীনা মুছ্যা লই।’ বলে কলিমুদ্দিন মাথার গামছাটা খুলে ঘাম মুছল। মিলিটারীগুলো অবাক বিস্ময়ে ওর ভীতিহীনতা লক্ষ্য করছে। ঘামটাম মোছা শেষ হলে কলিমুদ্দিন ওর টুকরি হতে বের করলো এক প্যাকেট সস্তা সিগারেট। ম্যাচ দিয়ে ফস করে সিগারেটটা জেলে প্যাকেটটা আর ম্যাচটা রেখে দিল টুকরির মধ্যে। এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে সে টুকরীর মধ্য হতে কি যেন একটা বের করল। তারপর-ক্ষিপ্রগতিতে সে জিনিসটা ছুড়ে দিল মিলিটারীদের দিকে।