পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/৩২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

305 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড রাত জাগি, হানাদার শত্রশিবির নিশ্চিহ্ন করে অন্যমনে পরিপূর্ণ ভিন্নজগতে- তখন সত্যি ভুলে যাই তোমার কথা। ভুলে যেতে হয়। সূর্য ওঠার স্বপ্ন নিয়ে যখন ক্যাম্পে ফিরি, তখন নিশুতি রাতে অসহায় ছিন্নমূল মানুষের কান্নার শব্দ ভেসে আসে। রাতজাগা দু’একটি পাখি পাখা ঝাপটায়। আমি বাতাসে তোমার ঘন ঘন নিঃশ্বাস শুনতে পাই। অনুভব করি। তুমিও বুঝি এতক্ষণেও কোনও ক্যাম্পে ফিরছ। সূর্য ওঠার এখনও দেরী। বাকি রাতটুকু আমাদের পাড়ি দিতে হবে। জমাটবাঁধা অন্ধকার ব্যারিকেড সবল বাহুতে উপড়ে ফেলে আবার প্রভাতসঙ্গীতের সুর শুনব জানালায় দাঁড়িয়ে প্রভাতসূর্যোদয়কে অভ্যর্থনা জানাবো। তুমি আমার বকুলমালা হাতে নিয়ে স্নিগ্ধ হাসবে। (মেসবাহ আহমেদ রচিত) রণশিবিরের একটি প্রত্যক্ষচিত্র ১৬ নভেম্বর, ১৯৭১ ছেলেটার কর্মক্ষিপ্রতা এবং কর্মপটুতা আমার প্রথম নজরে পড়ে। অথচ ও আমাকে দেখেনি- এতখানি একান্তচিত্তে সে হাতের যুদ্ধাস্ত্রগুলো নাড়ছিলো। রবিনবাবুর কাছে তার এলাকার কথা শুনতে শুনতে পারি যে বার-তের বছরের ছেলেটার দিকে বেশ মনোযোগী হয়ে পড়েছি তা তিনি লক্ষ্য করে বললেনঃ হ্যাঁ, ও ছেলেটার নাম আলো। ওর বাবা হালিম মাস্টার আমার ছোটবেলার বন্ধু। এই গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন তিনি। ওর আর এক ভাই ছিল। এখন তারা কেউ নেই। ও একা। আমি আগেই শুনেছিলাম, খুলনার দক্ষিণাঞ্চলের এই গ্রামটার ওপর হানাদার পাকবাহিনী জওয়ানরা দুবার হামলা করে। এবং শেষে এসে গ্রামের কাঁচাবাড়িগুলো পেট্রল ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। অবশ্য মুক্তিসেনা ভায়েরা তার মাশুলও আদায় করেছে এদের কাছ থেকে। তবু হানাদারদের অত্যাচারের পরিচয়টা সরেজমিনে জানতে আমি দীর্ঘ এগার-বার মাইল কাঁচা রাস্তা পায়ে হেঁটে সন্ধ্যার সময়ে সেখানে পৌঁছে যাই। গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ভায়েরা আমার পরিচয় জানার পর দলপতি রবিনবাবুর কাছে নিয়ে যায়। রবিনবাবু আমাকে জানালেনঃ আপনার কোন সিকিউরিটির অভাব হবে না। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। তবে রাতে গ্রামের ধ্বংসচিত্র দেখানো যাবে না- প্রধানতঃ আমাদের গ্রামের সবাইকে কড়া ডিফেন্স দিতে হচ্ছে। রাতের অাঁধারে দেখলাম গ্রামের খানা, ডোবা, নালা, আমাদের মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের এক-একটা মজবুত বাঙ্কার- সবাই অস্ত্র হাতে অতন্দ্র প্রহরী। সকালে রবিনবাবুর সাথে বিধ্বস্ত গ্রামের পোড়া বাড়ি, ভাঙ্গা ঘর, শূন্য উঠোন দেখে মনটা খা খা করে উঠলো। অথচ বাংলার এই গ্রাম একদিন নবান্নের ধানে গানে, ছেলেমেয়েদের কলকাকলীতে মুখর ছিল। তাদের অনেকে আজ হানাদারদের হাতে বলী হয়েছে। অনেকে চলে গেছে অন্যত্র নিরাপত্তার সন্ধানে। একটা আশ্চর্য নির্জনতার কালো গ্রামটাকে বিষাদে যেন ঘিরে রেখেছে। তবু, তবু দেখলাম- যারা আছে, যারা এখনো বাপদাদার ভিটে না ছেড়ে সাহসে নির্ভর করে আছে- তারা সেই নির্জনতার বুকে জীবন জাগিয়ে তোলার সাধনায় রত। ধীরে ধীরে তারা সকল প্রতিকূলতার মুখেও তাদের অধিকার রক্ষার সাহসে প্রত্যয় গড়ে তুলেছে মনের ভিতরে, বাইরে।