পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/৩৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

306 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড গ্রামের সবদিকে ঘুরে দেখে বেলা প্রায় সাড়ে বারটা নাগাদ রবিনবাবুর সাথে মুক্তিসেনা বন্ধুদের গ্রামের অফিসে ফিরলাম। টিনের ছাউনি দেয়া একটু ছোট ঘর, দুটো তক্তপোষ, একটা টেবিল, একটা চেয়ার- এই ওদের অফিস। ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে রবিনবাবুর কথা শুনছিলাম। কর্মরত ধবধবে ফরসা ছেলেটার দিক থেকে চোখ তুলে রবিনবাবুর দিকে তাকিয়ে বললামঃ কিন্তু ও একা কেন? রবিনবাবুর মুখের ওপর একটা কষ্টের ছাপ দেখলাম। রবিনবাবু একবার ছেলেটার দিকে এক নজর দেখলেন তারপর স্নান কণ্ঠে বললেনঃ হ্যাঁ, ও একা। ওর ভাই মনি ক্লাস নাইনে পড়তো। সে আমাদের মুক্তিবাহিনীর প্রথম গ্রুপের সাথে যোগ দেয়। মনির ছিল আশ্চর্য সাহস। পাকসেনারা প্রথমবার এসে গ্রামের মোড়ল হাজীসাহবের বাড়িতে আগুন দেয়। মনি আগুন নেভাতে গিয়ে পুড়ে মারা যায়। মনির মা কয়দিন পাগলের মতো হয়ে ওঠে। আলো মুক্তিসেনাদের সাথে আসতে চাইতো। কিন্তু ওর মা ওকে বুকে জড়িয়ে রাখতো সর্বদা। কিন্তু এমনটা ঐটুকু ছেলের ভাগ্যে আছে, কে বলবে বলুন? শেষবার যখন পাকসেনারা সমস্ত গ্রাম ধরিয়ে দিল, তখন একপ্রান্তে ওদের সাথে আমাদের ফাইট চলছে, অন্যদিকে গ্রামের নিরীহ নারী-পুরুষ উর্ধ্বশ্বাসে প্রাণভয়ে ছুটে পালাতে ব্যস্ত। হালিম মাস্টারের স্ত্রী, হালিম মাস্টার ও আলো ইতস্ততঃ দৌড়ানোর প্রাক্কালে অকস্মাৎ এক মিলিটারী ট্রাকের সামনে পড়ে যায়। বেঈমান পাকবাহিনীর লোকেরা হালিম মাষ্টারের ফরসা সুন্দরী স্ত্রীকে জোর করে ট্রাকে তুলে নেয়। বাধা দেওয়ার সাহস দেখাবার অপরাধে হালিম মাস্টারকে গুলি করে মেরে ফেলে। আলো ভয়ে ত্রাসে মা-মা-মা করে চীৎকার করে কাঁদতে থাকে- দসু্য ট্রাকটি ঘর ঘর শব্দ করে আলোর জলভরা চোখের সামনে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। গ্রামের কাঁচা বাড়িগুলো দাউ দাউ করে জুলতে থাকে। রবিনবাবু এখানে থামলেন। আমি বল্লামঃ তারপর? রবিন্দ্রবাবু বললেনঃ বহুকষ্টে আগুন আমরা নেভালাম- কিন্তু আপনি তো দেখেছেন এতবড় গ্রামে মাত্র গোটা ছয়-সাত বাড়ি রক্ষা হয়েছে। আমি আলোর দিকে তাকালাম। রবিনবাবু বললেনঃ আর ঐ আলো- তারপর দিন এলো আমাদের কাছে- বললেঃ আমি মুক্তিসেনা। তোমাদের সাথে যুদ্ধে যাবো। রবিনবাবু অল্প থেমে বললেনঃ আমার মনে হয়েছিল ওকে ফিরিয়ে দিই। গ্রামের কারো কাছে ও থাককেননা ও যে ওর পরিবারের শেষচিহ্ন। কিন্তু ওকে ফিরাতে পারিনি। ওর চোখের জলভরা প্রতিবাদ আমাকে জয় করলো। তারপর থেকে আলো আমাদের সাথে ওই শিবিরের প্রাণ ও ও গুলি ছুড়তে চায় বার বার। কিন্তু ও যে একেবারে বার বছরের শিশু। ওকে আশ্বাস দিয়েছিল আর কিছুদিন পরেই ও গুলি চালাবে। মুক্তিসেনা ভায়েরা সারারাত টহল দিয়ে সকালে প্রত্যেকের অস্ত্র আলোর জিন্মায় জমা দিয়ে যায়। এরপর সারাদিন অস্ত্রের সাথে আলোর খেলা। সে প্রত্যেকটা রাইফেল-ষ্টেনগান খুলবে, পরিষ্কার করবে, তেল দেবে। ওর হাতে অস্ত্রগুলো যেন শাণ পেয়ে চিক চিক করে ওঠে। সন্ধ্যাবেলায় ওই আলোই আবার প্রত্যেকের হাতে জীবন্ত অস্ত্রগুলো তুলে দেয়- এই ওর কাজ। এই কাজেও এত পটু যে বিশ্বাস করাই মুষ্কিল। আলোর দিকে চোখ ফিরে গেল দুজনেরই। আলো আশ্চর্য একাগ্রতায় তখনও কর্মরত। একঝাঁকড়া কালো চুল মাথায়- একটি কচি ফর্সা মুখ, ডগডগে দুটি চোখ- নরম নরম দুটি হাতে কি ভীষণ ব্যস্ততা আলোর। আলো কার মতো দেখতে? হয়ত ওর বাবার মত, নয়তো ওর মায়ের মতো- কিন্তু তারা যে আজ কেউ নেই। এমন অসম্ভব একটি দুঃস্বপ্ন ঐটুকু আলোর জীবনে ঘটেছে ভাবলে বড় পাষণ্ডেরও বোধ করি কষ্ট লাগে। আলো কাছে গেলাম।