পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/৮৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

64 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। আমি হতবাক হয়ে গেছি- বার বার বিস্ময়ে অবাক হয়ে যাচ্ছি- এই নারকীয় হত্যাকাণ্ড আর এই প্রাগৈতিহাসিক বর্বরতায় একজন মানুষের কোন চেতনা থাকা কি সম্ভব? টনি ক্লিফটন তাঁর রিপোর্টে বাংলাদেশে পাক-হানাদারদের হত্যা, নির্যাতন ও ব্যাভিচারের বর্ণনা দিতে গিয়ে বাংলাদেশের একটি সর্বহারা বালিকার এক মর্মান্তিক কাহিনী তুলে ধরেছেন। তিনি বলেনঃ লালফুল ও সবুজ লতাপাতা আকা গোলাপী রঙের একটা ছেড়া ফ্রকের আট-ন বছরের বালিকা ইসমত আরার মুখে আমি এক ভয়ঙ্কর আতঙ্কের প্রতিচ্ছবি লক্ষ্য করেছি। আমি তাকে দেখলাম শরণার্থী শিবিরের অনতিদূরে একটি হাসপাতালে। শত শত আহতদের ভিড়ের একপ্রান্তে সে দাঁড়িয়ে ছিলো। দিশেহারা দুটি ভিরু চোখ দিয়ে চারিদিকে সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলো। সে যে আহত আমি তা দূর থেকেই লক্ষ্য করলাম। মনে হলো শীর্ণ আলোর একটি রেখার মতো এই মেয়েটি তো কারও বিপদের কারণ হতে পারে না? এই ছোট্ট মেয়েটি ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীর কাছে কি এমন বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো যার জন্য তারা এভাবে আঘাত করেছে? একজন পাকিস্তানী সৈন্য বেয়োনেট দিয়ে তার ঘাড়ে আঘাত করেছে। তার শ্বাসনালি কেটে দিয়েছে। সে তার গলার ব্যাণ্ডেজের ওপর একটা হাত রেখে দাঁড়িয়ে ছিলো। আমি এগিয়ে গেলাম। মেয়েটি বললোঃ আমার নাম ইসমত আরা আমার বাবার নাম মরহুম ইশাক আলী। কুষ্টিয়ায় আমার বাবার দোকান ছিলো। দু’মাস আগে বাবা কুষ্টিয়ায় রওয়ানা হয়েছিলেন সেই রাতে আমি ঘুমোবার আগে বাইরে কোলাহল আর ভারী ভারী পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। কি হচ্ছে না হচ্ছে দেখতে যাওয়ার আগেই দেখতে পেলাম অনেকগুলো পাক সৈন্য আমাদের ঘরে ঢুকে পড়েছে। তারা আমাদের ঘরে ঢুকেই আমার দাদাকে গুলি করে। আমার দাদা বি-এসসি পাস করেছিলো। তারপর তারা আমার মা ও বোনদের ওপর অত্যাচার চালায় এবং তাদের শেষ পর্যন্ত বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলে। একজন সৈন্য লাফ দিয়ে এসে আমাকে আঘাত করে। তারা বেয়োনেট দিয়ে আমার গলায় আঘাত করার সঙ্গে সঙ্গে আমি পড়ে যাইে এবং মৃতের ভান করি। তারপর সৈন্যরা চলে গেলে পরের দিন একজন লোক দিয়ে আমাকে অচেতন অবস্থায় তুলে নিয়ে আসে। এই কথাগুলো বলার সঙ্গে সঙ্গে সে যেন কেমন হয়ে পড়েছিলো। সেই বীভৎস দৃশ্য যেন তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো। সে তা সহ্য করতে না পেরে হঠাৎ সরে গেল আমার কাছ থেকে। আর তাকে দেখতে পেলাম না। আমি তার ওয়ার্ডের ডাক্তারের সংগে আলাপ করলাম। ডাক্তার আমায় জানালেন, একদিন আকে ভদ্রলোক তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় এখানে নিয়ে আসে। এরপর হাসপাতালে আহত শরণার্থীদের ভিড় ঠেলে আমি যখন বাইরে বের হচ্ছিলাম ঠিক সেই সময় ইসমত আরা দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। তার দুচোখের কোণায় জল টলমল করছিলো। কাঁপা কাঁপা ঠোঁট নিয়ে সে আমায় জিজ্ঞেস করলোঃ বলুন না এখন আমি কি করবো? জানেন আমরা পাঁচ বোন ছিলাম, আমার ভাই ছিলো, মা-বাবা ছিলো। কতো সুন্দর আমাদের ঘরবাড়ি ছিলো। আজ আমার কেউ নেই, কিছু নেই। আজ আমি এতিম। বলুন না, আমি কোথায় যাবো? আমার কি হবে? আমি তাকে বললাম, আর তো কোন ভয় নেই। তুমি এখানে চলে এসেছ, এখন তোমার ভয়ের কিছু নেই। কপট এক নির্বোধের মতো আমি তাকে সান্তনার কথাগুলো বললাম- কিন্তু ইসমত আরার কি হবে? কি হবে আরও হাজার হাজার ইসমত আরার? টনি ক্লিফটন তাঁর রিপোর্টে উল্লেখ করেন যে, আমেরিকার নিউজার্সির কংগ্রেস সদস্য মিঃ কর্নেলিয়াস গ্যালাঘার আমায় বলেছেন যে, পাক বাহিনীর বর্বরতার খবর অতিরিক্ত বলে আমি প্রথমে মনে করেছিলাম এবং প্রকৃত সত্য যাচাইয়ের জন্যেই আমি শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করতে গিয়েছিলাম কিন্তু আমি যা দেখেছি তা অবর্ণনীয়। মিঃ গ্যালাঘার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন বাহিনীর একজন বিখ্যাত সামরিক অফিসার ছিলেন। তিনি বলেছেনঃ দ্বিতীয় বিশ্ব মহাসমরের সময় ফ্রান্সের বিধ্বস্ত এলাকাগুলো আমি দেখিছি- মর্মান্তিক বধ্যভূমিগুলোও আমি দেখেছি, কিন্তু আমি এমনটি কখনও দেখিনি। এ বীভৎসতা, এ বর্বরতার কোন তুলনা হয় না।