পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/১২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খণ্ড
৯৬

ইস্তাহার

 গত বৎসর পূর্ব পাকিস্তানের সাতশত কর্মীর সহযোগিতা ও চেষ্টার মধ্য দিয়া গণতান্ত্রিক “যুবলীগ” জন্মলাভ করে। যুবলীগের গঠনের পিছনে মূল প্রেরণা ছিল পাকিস্তানকে একটি স্বাধীন, সুখী ও গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে গড়িয়া তোলা। সেই জন্য গত যুব সম্মেলনে প্রগতিশীল আদর্শের উপর ভিত্তি করিয়া একটি “গণদাবীর সনদ” রচিত ও গৃহীত হয়, সেই আদর্শের উপর ভিত্তি করিয়া পাকিস্তান রাষ্ট্রকে গড়িয়া তুলিবার জন্য যুবশক্তির নিকট আহ্বান জানান হয় এবং এই পথে রাষ্ট্রকে গড়িয়া তুলিবার কাজে সরকারকে সকল রকম সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

 যুবলীগ প্রতিষ্ঠার পরে পুরা এক বছর চলিয়া গিয়াছে। পূর্ব পাকিস্তানের মজুর কৃষক, মধ্যবিত্ত প্রভৃতি সকল শ্রেণীর যুবকদের মধ্যে আজ প্রশ্ন জাগিয়াছে গত যুব সম্মেলনে যে গণদাবীর সনদ রচিত হইয়াছিল, যে প্রেরণা ও চেতনা লইয়া যুবকগণ পাকিস্তান রাষ্ট্রকে গড়িয়া তুলিবার স্বপ্ন দেখিয়াছিল গত এক বছরে তাহার কতটুকু সফলতা লাভ করিয়াছে? আমরা কি পূর্ণ স্বাধীনতা, সুখ ও গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হইতেছি, না ক্রমেই সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের পাকে জড়াইয়া পড়িতেছি, দেশবাসীর জীবনে দুঃখ-দুর্দশা কমিতেছে না আরও বাড়িয়া চলিয়াছে। আমাদের বর্তমান দুঃখ-দুর্দশা, গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ ও বৃটিশ আধিপত্যের জন্য দায়ী কে এবং কোন পথেই বা ইহার আবসান হইতে পারে, ইহাই আজ প্রত্যেক গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন যুবকের মনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। যে “গণদাবীর সনদ” আমরা গত ঢাকা সম্মেলনে গ্রহণ কায়িাছিলাম তাহা কোন অবস্থার মধ্যে কার্য্যকরী হওয়া সম্ভব, বর্তমান সরকার দ্বারা ঐ সনদকে কার্য্যে পরিণত করা সম্ভব কিনা এবং তাহা সম্ভব না হইলে কোন কর্ম্মপন্থার ভিত্তিতে আমরা অগ্রসর হইব এই সকল মূল প্রশ্ন এড়াইয়া যাওয়ার ফলেই আমাদের “গণদাবীর সনদ” একটি আদর্শ পরিকল্পনাই মাত্র রহিয়া গিয়াছে, ইহাকে কার্য্যে পরিণত করিবার সংগ্রাম আজও গড়িয়া উঠে নাই। ইহার ফলে প্রথম কিছুটা কর্মচাঞ্চল্যের পরেই যুবলীগ ঝিমাইয়া পড়িয়াছে। আমাদের এই ঝিমাইয়া পড়া অবস্থার কারণ ইহাই নয় যে পাকিস্তানের যুবলীগ আজ নির্জীব ও অকর্ম্মণ্য বরং একথা খুব জোরের সাথেই বলা চলে যে বর্তমান দুঃখ-দুর্দশা আজ কৃষক, মজুর ও মধ্যবিত্ত যুবককে যত বেশী চঞ্চল করিয়া তুলিয়াছে, যত বেশী কর্মপ্রেরনা সৃষ্টি করিয়াছে অতীতে কোনদিনই এরূপ হয় নাই। যুবকগণ আজ একথা বুঝিয়াছে যে শুধুমাত্র একটা আদর্শ প্রোগ্রাম হাজির করিলে বা তাহাকে প্রচার করিলেই চলিবে না। তাহাকে কার্যকরী করিবার জন্য সক্রিয় কর্মপন্থাও গ্রহণ করিতে হইবে। আমাদের গত সম্মেলন সে সম্বন্ধে কোনও নির্দেশ দিতে পারে নাই সে জন্যই আজ পাকিস্তানের যুবশক্তি বিপুল কর্ম্মক্ষমতা লইয়াও বর্তমান অবস্থার নিরপেক্ষ দর্শকমাত্র হইয়া রহিয়াছে। অতীতে দেখা গিয়াছে যখনই তাহাদের কাছে সংগ্রামের আহ্বান আসিয়াছে তখন তাহাতে সাড়া দিতে একটুকুও দ্বিধাবোধ করে নাই।

 গত বাংলা ভাষা আন্দোলন দুটি সত্য আমাদের সম্মুখে খুলিয়া ধরে। প্রথমতঃ একথা পরিষ্কার ধরা পড়ে যে আমাদের গণদাবীর সনদের সর্ব্বনিম্ন দাবী বাংলা ভাষার অধিকার অর্জন করিতেও যুবশক্তি বর্তমান শাসক শ্রেণীর কাছ হইতে লাঠি, গুলি, কাঁদুনে গ্যাস ও জেল পাইয়াছে। ইহাতেই দেখা যায় আমাদের সনদের অন্যান্য মূলদাবী আদায় করিতে হইলে আমাদিগকে কি বিরাট বাধার সম্মুখীন হইতে হইবে। দ্বিতীয়তঃ ইহাও দেখা যায় যে, পাকিস্তানের যুবশক্তি বর্তমান শাসক শ্রেণীর সকল আঘাত উপেক্ষা করিয়াও আন্দোলনের আহ্বানে কিভাবে সাড়া দিয়াছে।

 “বাংলা ভাষা আন্দোলনের” শিক্ষা আমরা ঠিকমত বুঝিয়া সময়মত নেতৃত্ব না দিবার ফলেই বিপুল সম্ভাবনা সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানের যুব আন্দোলনে ভাটা পড়িয়াছে। আমাদের গণদাবীর সনদ শুধুমাত্র কাগজপত্রের থাকিয়া গিয়াছে।