পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/১২৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খণ্ড
৯৮

করিয়া আজ সকল রকম প্রগতিশীল আন্দোলন ধ্বংস করিতেছে এবং তাহারাই পাইতেছে শাসকমণ্ডলীর পূর্ণ সমর্থন। খুশীমত ১৪৪ ধারা জারী করিয়া সভা সমিতি বন্ধ করা, যে কোন রকম মজুর কৃষক আন্দোলনকেই বে-আইনী কাজ হিসাবে দমন করা, যথেচ্ছাভাবে খানাতল্লাশী চালানো, গোয়োন্দা বিভাগের অঙ্গুলী হেলনে যে কোন ব্যক্তিকে যত দিন খুশী বিনা বিচারে আটক রাখা বা প্রদেশ হইতে বহিষ্কৃত করা আজ প্রতিদিনের ঘটনা হইয়া দাঁড়াইয়াছে। শত শত বৎসরের লড়াই ও ত্যাগের মধ্য দিয়া যতটুকু ব্যক্তিস্বাধীনতা আমরা অর্জন করিয়াছি বর্তমান শাসকমণ্ডলীর হাতে তাহাও বিপন্ন হইয়া পড়িয়াছে। “পঞ্চম বাহিনী”, “রাষ্ট্রের শত্রু”, “কমিউনিষ্ট” প্রভৃতি মামুলী আখ্যা দিয়া চরম দমননীতি প্রয়োগ করিয়া বর্তমানে মন্ত্রীসভা সমস্ত ক্ষমতা নিজের মুষ্ঠির মধ্যে আনিয়া পুলিশ, গোয়েন্দা ও ধনিক শ্রেণীর খেয়ালের উপর পূর্ব পাকিস্তানের পৌনে পাঁচ কোটি লোকের ভাগ্য ছাড়িয়া দিয়াছে। জমিদার, জোতদার, মিল মালিক প্রভৃতি ধনিক গোষ্ঠীর স্বার্থে আঘাত লাগে এরূপ যে কোন আন্দোলনকেই দমন করা ও রাষ্ট্রের শত্রু আখ্যা দেওয়ার মধ্য দিয়াই রাষ্ট্রের বর্ত্তমান কর্ণধারগণের স্বরূপ ধরা পড়ে। বাংলা ভাষা আন্দোলনের উপর নির্ঘুম আঘাত হানার মধ্যে দিয়া ইহাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারবিরোধী মনোভাবও প্রকাশ পাইয়াছে।

 এক কথায় বলিতে গেলে যে মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার আমরা দাবী করিয়াছিলাম বর্তমান শাসকমণ্ডলী তাহার কোন মর্য্যাদাই দেয়া নাই।

আর্থিক গণতন্ত্র?

 কোন দেশের রাজনৈতিক কাঠামো কিরূপ তাহা ভালবাবে বুঝিতে হইলে সেই দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে প্রথমে লক্ষ্য করিতে হয়। যে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা শোষণ ও জুলুমের ভিত্তিতে গঠিত অর্থাৎ দেশের শতকরা ৯৫ জন লোককে শতকরা মাত্র ৫ জন লোকের স্বার্থেই খাটিয়া মরিতে হয়, যে দেশে বড় বড় মোটা বেতনের আমলা পুষিয়া গরীব কেরানী ও মজুরকে ছাঁটাই করা হয়- এ কথায় বলিতে গেলে যে দেশে অর্থনৈতিক সাম্য বলিয়া কোন জিনিষ নাই সে দেশে রাজনৈতিক গণতন্ত্র বলিয়াও কিছু থাকিতে পারে না। ইংরাজ সরকার তাহার শোষণ ও শাসন বজায় রাখিবার জন্য আমাদের দেশে একদিকে জমির উপর একদল পরগাছা সৃষ্টি করিয়াছে অপর দিকে শিল্পের দিক দিয়া আমাদের দেশকে অনগ্রসর করিয়া রাখিয়াছে। মুষ্টিমেয় জমিদারের স্বার্থে কোটি কোটি কৃষককে শোষণ করা হইতেছে এবং অপর দিকে বেকারের দল সৃষ্টি হইয়াছে। সেইজন্য আমাদের আজাদীর লড়াইয়ের মূল কথাই ছিল ইংরাজের তৈরী অর্থনৈতিক কাঠামো ভাঙ্গিয়া চুরমার করিয়া সেই স্থলে নূতন গণতান্ত্রিক অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরী করা। আমাদের নূতন অর্থনৈতিক কাঠামোর মূল ভিত্তিই হইবে বিনা খেশারতে জমিদারী প্রথা ধ্বংস করিয়া কৃষককে জমির মালিক বলিয়া ঘোষণা করা এবং যে সকল ক্ষেত্রে একজন লোকের হাতে অধিক পরিমাণে আবাদী জমি একীভূত হইয়াছে সে সকল ক্ষেত্রে সমস্ত প্রয়োজনাতিরিক্ত জমি বাজেয়াপ্ত করিয়া তাহা গরীব কৃষক ও দিনমজুরদের মধ্যে বিতরণ করা। যাহারা চাষের হাল-বলদ কিনিতে পারিতেছে না, জমিতে সার দিতে পারিতেছে না তাহাদিগকে সরকার হইতে সাহায্য করা। অথচ বর্তমান সরকার জমিদারী উচ্ছেদের যে বিল আনিয়াছে তাহাতে “শিশু রাষ্ট্রের” পকেট হইতে ৪০ কোটি টাকা খেসারত ব্যবস্থা হইয়াছে, জোতদারকে ২০০ শত বিঘা জমি রাখিতে দেওয়া হইয়াছে, জমিদারের ঋণ লাঘবের ব্যবস্থা হইয়াছে, জমিদার জোতদারের জন্য সকল রকমেরই রক্ষাকবচের ব্যবস্থা হইয়াছে কিন্তু এই বিলের ফলে কৃষক কি পাইবে, আধিয়ার ও দিনমজুরের ভাগ্যের কি পরিবর্তন হইবে শুধু সেইটাই খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। এক কথায় বলিতে গেলে এই বিল কৃষকের স্বার্থে রচিত হয় নই- জমিদারের স্বার্থেই রচিত।

 কর্মচারী, কেরানী, শিক্ষক প্রভৃতি সম্বন্ধে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক নীতির অর্থ এই যে, যে দেশের কোটি কোটি লোকের পেটে ভাত নাই, পরনে কাপড় নাই, ঘরে বাতি নাই সে দেশের মন্ত্রী বা উচ্চ অফিসারদের কখনও মাহিনা, ভাতা প্রভৃতি দিয়া চার-পাঁচ হাজার টাকা মাসিক আয় বরদাশত করা চলে না। যাহারা একজন রেলমজুরকে ও একজন প্রাইমারী শিক্ষককে ১৫/২০ টাকা মাহিনা দিতে লজ্জা বোধ করে না তাহারা নিজেরাই বা