পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/১২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খণ্ড
৯৯

পাঁচ হাজার টাকা লয় কিভাবে ও ইংরাজ আমলের অত্যাচারী ও দুর্নীতিপরায়ণ আমলাদের হাজার হাজার টাকা বেতন দিয়া পুষিতেছে কিভাবে? বর্তমান অবস্থায় কোন মজুর ও কর্মচারীর বেতন ও ভাতা ১০০ টাকার কম হইতে পারে না এবং কোন উচ্চপদস্থ কর্মচারীই বেতন ৫০০ টাকার বেশী হওয়া উচিত নয়। অথচ আমাদের সরকার মুখে ইসলামী সমাজতন্ত্রের কথা বলিয়া কার্য্যক্ষেত্রে ইংরাজ আমলের শোষণ ও অসাম্যের উপর প্রতিষ্ঠিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকেই কায়েম রাখিতেছে। ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা বৃটিশ আমলকেও লজ্জা দেয়।

 শিল্প বিস্তারের ব্যাপারে সরকার মজুর ও জনসাধারণের সক্রিয় সহযোগিতা লাভ করিয়াছে, অপরদিকে তেমনি মুষ্টিমেয় ধনিকের হাতে না জমিয়া কোটি কোটি টাকা সরকারের হস্তগত হইয়াছে, যাহা দিয়া নূতন শিল্প গড়িয়া তোলা, পুরাতন শিল্পকে প্রসার করার সুযোগ পাওয়া গিয়াছে। এই পথেই তাহারা জনসাধারণের আয় বাড়াইয়াছে, জিনিষের দর কমাইয়াছে এবং বেকার সমস্যার সমাধান করিয়াছে। এই ব্যবস্থা গ্রহণ করার ফলে মুষ্টিমেয় ধনিক, রাজা, জমিদার ও বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী তাহাদের শত্রু হইয়াছে বটে কিন্তু দেশের কোটি কোটি মজুর, কৃষক ও মধ্যবিত্ত রাশিয়া রাষ্ট্রের নিরাপত্তার ভার গ্রহণ করিয়াছে, রাষ্ট্র পরিচালনায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করিয়াছে। সেই জন্যই দেখা যায় যুদ্ধের নিদারুন ক্ষয়ক্ষতি সহ্য করা সত্ত্বেও সোভিয়েট রাশিয়া ও নয়া গণতান্ত্রিক দেশসমূহ কেবলমাত্র নিজ শক্তির উপর ভরসা করিয়াও পরস্পরের সাথে সহযোগিতা করিয়া অতি দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতির পথে অগ্রসর হইতেছে। আর মার্কিন ধনকুবেরগণের সাহায্য লাভ করিয়া পশ্চিম ইউরোপের দেশসমূহ, চিয়াংকাইশেকের চীন প্রভৃতি কেবল সম্মেলন করিয়া বেড়াইতেছে ও অর্থনৈতিক সংকটে হাবুডুবু খাইতেছে।

 যাহারা নিজের দেশের ধনিকদের তোষণ ও লালপালন করে অর্থের জন্য তাদেরই বিদেশী সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে হাত পাতিতে হয় এবং তদ্বারা অভ্যন্তরীণ ব্যাপারেও বিদেশী প্রভুদের হস্তক্ষেপ ডাকিয়া আনিতে হয়। এইভাবেই অর্থনৈতিক গোলামী হইতে রাজনৈতিক গোলামীর সৃষ্টি হয়।


 সেইজন্য পাকিস্তান সরকার অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ধনিক তোষণ ও কৃষক মজুর আন্দোলনে ধ্বংসের পথ গ্রহণ করিয়াও আন্তর্জাতিক ব্যাপারে বৃটিশ ও আমেরিকার লেজুড়ে পরিণত হইয়াছে। ইহার ফলেই নেতারা বৃটিশ সম্পর্কোচ্ছেদের বদলে বৃটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত থাকিবার কথা বলিতেছেন, রাজার জন্মদিবস পালন করিতেছেন। ইহা আজাদীর পথ নয়, গোলামীর পথ, শিল্প বিস্তারের পথ নয়, বিদেশী পুঁজিপতিদের স্বার্থে দেশের শিল্পবিস্তার বন্ধ রাখার পথ ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার বদলে অর্থনৈতিক দাসত্বের পথ।

 সত্যিকারে, আজাদীর শিল্প বিস্তার ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার পথে বর্তমানে শাসকমণ্ডলী অগ্রসর হইতে পারেন না, কারণ তাহা হইলে কৃষক, মজুর ও গরীব মধ্যবিত্তের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা না করিয়া মিল মালিক, জমিদার, জোতদার, বিদেশী পুঁজিপতি, মুনাফাখোর, বড় ব্যবসায়ী ও মোটা বেতনের দেশী-বিদেশী অফিসারদের বিরুদ্ধেই জেহাদ ঘোষণা করিতে হইবে। দুই নৌকায় পা দিয়া চলা আজ অসম্ভব। হয় ধনিকের শাসন ধ্বংস করিয়া মেহনতকারী জনসাধারণকে বাঁচাইতে হইবে আর না হয় মেহনতকারী জনসাধারণকে বুক্ষু রাখিয়া ধনিকের ধন-দৌলত বাড়াইতে হইবে। কোন দেশ কোন পথে যাইবে তাহা নির্ভর করে সেই দেশের শাসক শ্রেণী কোন দলের প্রতিনিধি তাহার উপর। সোভিয়েট রাশিয়া ও নয়া গণতান্ত্রিক দেশসমূহে কৃষক, মজুর ও গরীব মধ্যবিত্ত রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করিয়াছে সেই জন্যই সেখানকার জনগণ আজ খাঁটি আজাদী গণতন্ত্র ও সুখ ভোগ করিয়াছে, আর উন্নতির পথে আগাইয়া চলিয়াছে। গত এক বৎসরের কার্য্যকলাপের ফলে একথা ক্রমেই স্পষ্ট হইয়া উঠিতেছে যে পাকিস্তানের শাসক শ্রেণী ধনিক শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসাবেই কাজ করিতেছে এবং সেই জন্যই দেশবাসীর জীবনে দুঃখ-দুর্দশা নামিয়া আসিয়াছে। সরকার বলে “সময় দাও” কিন্তু আমাদের প্রশ্ন যে এক বৎসর সময় আমরা দিলাম তাহা কাহার স্বার্থে কিভাবে ব্যবহার করা হইল? এই এক বৎসরে কি তাহারা বৃটিশ সম্পর্কোচ্ছেদ, ধনিক শ্রেণীর উচ্ছেদ, চোরাকারবারী ও মুনাফাখোরী ধ্বংস ও কৃষক মজুর মধ্যবিত্তের উন্নতির