পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/১২৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খণ্ড
১০০

কাজে ব্যয় করিয়াছে, না দেশী বিদেশী ধনিক তোষণ ও গরীব হত্যার কাজে ব্যয় করিয়াছে? সময় পাইলেই যদি ধনিক শ্রেণীর উচ্ছেদ হইত, জনসাধারণ পেটে ভাত, পরনে কাপড় পাইত তাহা হইলে আমেরিকা ও ইংলেণ্ডে আজ কোটিপতিরা দেশের মালিক কেন? সেখানকার মজুরদেরও মজুরী বৃদ্ধির জন্য ধর্মঘট করিতে হয় কেন? আর মাত্র ২/৩ বৎসর সময়ের মধ্যে আলবেনিয়া, হাঙ্গেরী, পোলাও প্রভৃতি দেশ তাহাদের ভাগ্য পরিবর্তন করিতে পারিল কেন?

 সময় পাইলেই সব ঠিক হইবে একথা সম্পূর্ণ মিথ্যা, সরকারী কর্তৃপক্ষ কাহার স্বার্থে রাষ্ট্র পরিচালনা করিতেছে-ধনিকের না গরীবের? এটাই হইল আসল প্রশ্ন। যে সরকার ধনিকের স্বার্থে রাষ্ট্র পরিচালনা করে তাহাকে সময় দেওয়ার অর্থ ধনিকের শক্তিবৃদ্ধি করিতে সুযোগ দেওয়া মাত্র।

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা

 যে রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক গণতন্ত্রের স্থান নাই; সেই রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা আশা করা বৃথা।

 আমরা দাবী করিয়াছিলাম সকলের কাজ করিবার অধিকার চাই, গ্রামে গ্রামে বিনা বেতনে শিক্ষা দিবার স্কুল চাই, প্রতি ইউনিয়নে সরকারী ডাক্তার চাই। বলা বাহুল্য যে, ইহার কোনটাই আমরা পাইতেছি না এবং পাইবার কোন সম্ভাবনাও দেখিতেছি না। প্রত্যেকের কাজের অধিকারের বদলে পাইতেছি বেকার সমস্যা; গ্রামে গ্রামে স্কুলের পরিবর্তে বর্তমানে সামান্য কয়টি স্কুল ও সরকারী শিক্ষা বিভাগের খেয়ালমত ভাঙ্গা গড়া ইত্যাদি। স্বাস্থ্যের উন্নতি দূরের কথা সরকারী খরচে মাত্র যে কয়জন Health Assistant টিকা, ইনজেকশন দিবার জন্য রাখা হইয়াছে তাহাদেরও বরখাস্তের বন্দোবস্ত হইতেছে। শ্রমিক, কৃষক, নারী জাতি প্রভৃতির জন্য আমরা যে সকল অধিকার দাবী করিয়াছিলাম, একটি সুখী সমাজ ব্যবস্থা গড়িবার যে আদর্শ, যে কর্মপন্থা আমরা গ্রহণ করিয়াছিলাম বর্তমান শাসকমণ্ডলীর দ্বারা তাহা সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হইয়াছে। গত এক বছরে নূতন সমাজ ব্যবস্থা গড়িয়া তোলা দূরে থাকুক পুরাতন জরাজীর্ণ ব্যবস্থাও ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীকে নূতন অধিকার দানের বদলে পুরাতন অধিকার কাড়িয়া লওয়া হইয়াছে।


 বর্তমান শাসক শ্রেণী খাদ্য সমস্যার সমাধান করিতে পারিতেছে না অথচ খবরের কাগজে বিবৃতি দিতেছে যে দেশে খাদ্য সমস্যা নাই। কোন জিনিষেরই দর কমাইতে পারিতেছে না। সকল রকমের কুটির শিল্প ধ্বংস হইয়া যাইতেছে। ছাঁটাই প্রভৃতির ফলে বিরাট আকারে বেকার সমস্যা দেখা দিয়াছে। এক কথায় বলিতে গেলে লোকের আয় ক্রমেই কমিতেছে আর ব্যয় বহুলাংশে বাড়িয়া চলিয়াছে, অথচ সরকারী কর্তৃপক্ষ ইহার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করে নাই। কিন্তু রেল শ্রমিক, সরকারী কর্মচারী প্রভৃতি যখন নিজ নিজ ইউনিয়ন মারফত বর্তমান ব্যবস্থার প্রতিকারের জন্য আন্দোলন, ধর্মঘট প্রভৃতির দিকে আগাইয়া আসে তখন সরকার ইউনিয়ন নেতাদের গ্রেপ্তার, বরখাস্ত, বদলী, ১৪৪ ধারা জারী প্রভৃতি দ্বারা ইহার জবাব দেয়। কাপড় ও চিনির কলের মালিকরা যখন উৎপাদক মজুর শ্রেণী, ক্রেতা ও মধ্যবিত্ত ও কৃষক শ্রেণীকে শোষণ করিয়া কোটি কোটি টাকা মুনাফা লুট করে তখন সরকার নিরপেক্ষ দর্শকের ন্যায় সবই মুখ বুজিয়া সহ্য করে। অথচ মজদুর শ্রেণী যখন বাধ্য হইয়া জীবন ধারণের উপযোগী মজুরী, ছুটি প্রভৃতির দাবী লইয়া আন্দোলন ও ধর্মঘটের পথে অগ্রসর হয় তখন সরকার মিল মালিকের পক্ষেই হস্তক্ষেপ করাকে পবিত্র কর্তব্য বলিয়া মনে করে। আমরা আজাদী পাইয়াছি, কিন্তু এখনও রেল শ্রমিক ও যাত্রীদের শোষণ করিয়া কোটি কোটি টাকা ইংরাজ পুঁজিপতিদের জন্য বিলাতে পাঠাইতে হয়। যে সকল ইংরাজ অফিসার আমাদের দেশে চাকুরী করার নামে শোষণ ও শাসনের যন্ত্র হিসাবে কাজ করিয়াছে, আমাদের দেশের স্বাধীনতাকামী জনসাধারণের বুকের রক্ত দিয়া হাত রাঙ্গাইয়াছে, সেলামীস্বরূপ তাহাদের পেনসনের টাকা বিলাতে পাঠাইতে হয়। অথচ আমাদের দেশেরই গরীব মজুর ও শিক্ষকের দল না খাইয়া থাকে।